দল সমাজকর্মঃ বৈশিষ্ট্য, উপাদান, নীতি, প্রক্রিয়া ও প্রয়োগক্ষেত্র
সামাজিক দল
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধতা ছাড়া মানুষের একার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। সমাজে বাস করতে গিয়ে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু মানুষ খুব কাছাকাছি হয়। নিজেদের মধ্যে তৈরি হয় পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ইত্যাদি। আর এভাবেই মানুষ একটি দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। সাধারণভাবে একের অধিক লোক যখন কোনো সাধারণ উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে তখন তাকে দল বলে। অন্যদিকে সামাজিক দল হলো কতগুলো মানুষের সমষ্টি, যারা সুনির্দিষ্ট সামাজিক লক্ষ্য অর্জনে একত্রিত হয়ে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে থাকে।
শেরিফ এন্ড শেরিফের মতে, একটি দল হলো কতগুলো ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি সামাজিক একক। এখানে ব্যক্তিগণ পারস্পরিক মর্যাদা ও ভূমিকার অংশীদার হয়। এক্ষেত্রে সদস্যদের আচরণের নির্দেশনা হিসেবে দলের কতগুলো নিজস্ব আদর্শ বা মূল্যবোধ থাকে।
রামনাথ শর্মার মতে, সামাজিক দল হলো ব্যক্তির মধ্যে সংগঠিত চুক্তি, যার সদস্যদের মধ্যে সাধারণ লক্ষ্য, স্বার্থ, উদ্দীপনা এবং পারস্পরিক আবেগ, সম্পর্ক এবং আন্তঃক্রিয়া বজায় থাকে।
সূতরাং
বলা যায় যে, সামাজিক দল হলো একাধিক লোকের সমষ্টি যারা সুনির্দিষ্ট কিছু সামাজিক উদ্দেশ্য
অর্জনের জন্য
পারস্পরিক
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে তারা সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে
থাকে।
সামাজিক দলের বৈশিষ্ট্য
Hans Raj তাঁর Introduction to Sociology গ্রন্থে সামাজিক দলের কতগুলো বৈশিষ্ট্যের
কথা বলেছেন। যেমন :
১. দলের
সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যামান থাকে;
২. দলের
সদস্যদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি থাকে এবং নিজেরা একাত্ববোধ অনুভব করে;
৩. দলের
সদস্যরা পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে;
৪. সদস্যরা
দলের সাধারণ উদ্দেশ্য বা স্বার্থ অর্জনে সম্মিলিতভাবে কাজ করে;
৫. দলের
সদস্যরা সাধারণ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একই ধরনের পথ অনুসরণ করে; এবং
৬. দলের
সদস্যরা দলীয় আদর্শ মেনে চলে।
সার্বিকভাবে
সামাজিক দলের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিন্মরুপ :
১. এটি
একটি সামাজিক একক, যা দুই বা ততোধিক লোকের সমষ্টি;
২. এক
বা একাধিক সাধারণ উদ্দেশ্য অর্জনে এর সদস্যগণ একত্রিত হয়;
৩. সদস্যদের
মধ্যে মনো-সামাজিক ঐক্য বিদ্যমান থাকে;
৪. দলের
মধ্যে পরিবর্তন ও গতিশীলতা বিদ্যামান;
৫. সামাজিক
দল অপেক্ষাকৃত স্থায়ী;
৬. দলের
মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে যোগাযোগ বিদ্যমান থাকে;
৭. সাধারণ
নেতৃত্বের ভিত্তিতে দল পরিচালিত হয়;
৮. সাধারণ
আদর্শ ও মূল্যবোধ বিদ্যমান, যা দলের সকল সদস্য মেনে চলে;
৯. দলের
প্রতি সদস্যদের সাধারণ আনুগত্য বিদ্যমান থাকে। এর ভিত্তিতে সদস্যরা তাদের যৌথ স্বার্থকে
রক্ষা করে; এবং
১০. দলের
সদস্যরা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ভূমিকা ও মর্যাদার অংশীদার হয়।
সামাজিক দলের শ্রেণিবিভাগ
সামাজিক দলসমূহকে এদের গঠন, আকৃতি, সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক, বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য, কার্যক্রম প্রভৃতির আলোকে নিন্মোক্তভাবে ভাগ করা যায়। যথা :
১. প্রাথমিক দল : প্রাথমিক দল হলো সবচেয়ে সহজ ও সর্বজনীন সামাজিক দল। প্রাথমিক দল বলতে সেই দলকে বোঝানো হয় যার সদস্যদের মধ্যে প্রত্যক্ষ পরিচিতি, অন্তরঙ্গতা ও যোগাযোগ বিদ্যমান থাকে। এ দলের পরিধি বা সদস্য সংখ্যা সীমিত সংখ্যক থাকে। সদস্যদের আচরণে আনুষ্ঠানিকতা কম এবং স্থায়ীত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি। এ ধরনের দলকে face to face group বলা হয়। এদের মধ্যে আমরা ভাব (We Feeling) প্রকট থাকে। পরিবার, খেলার দল, প্রতিবেশি এ দলের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
২. গৌণ দল : বৃহত্তর সমাজে বসবাস এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জীবন ধারনের মৌলিক প্রয়োজন পূরণে গৌণ দলের ভূমিকাই প্রধান। গৌণ দলের সদস্যদের সম্পর্ক অনেকটা রীতি মাফিক। এদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা কম থাকে। কতগুলো নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে এ দল গড়ে ওঠে। এ ধরনের দলের সদস্য সংখ্যা ও পরিধি তুলনামূলকভাবে ব্যাপক। দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব অপেক্ষাকৃত বেশি এবং স্থায়ীত্ব কম। ট্রেড ইউনিয়ন, বাণিজ্যিক সংঘ, ক্লাব এ দলের উদাহরণ।
৩. অন্তঃদল : ব্যক্তি যে দলের সদস্যভুক্ত এবং যে দলের সদস্যদের সাথে তার অন্তরঙ্গতা, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতি, আবেগ, আনুগত্য বজায় থাকে সেটি ব্যক্তির নিকট অন্তঃদল। এ দলের সাথে ব্যক্তির দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক ঘনিষ্ট থাকে। অন্তঃদলের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সমবায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দলের জন্য উৎসর্গকৃত মনোভাব বিদ্যমান থাকে। এ দলকে We Group বলা হয়। প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে তার নিজস্ব পরিবার, ক্লাব, সমিতি হলো তার অন্তঃদল।
৪. বহিঃদল : ব্যক্তি যে দলের সদস্য নয় এবং যে দল সস্পর্কে সে উদাসীনতা ও বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করে তাই হলো ব্যক্তির বহিঃদল। এটাকে They Group ও বলা হয়। খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো এ দলের উদাহরণ।
৫. আনুষ্ঠানিক দল : আনুষ্ঠানিক চুক্তি বা আঙ্গীকারের ভিত্তিতে যে দল গড়ে ওঠে তাই আনুষ্ঠানিক দল। এ দলের সদস্যদের নির্দিষ্ট আদর্শ, মূল্যবোধ ও নীতিমালা অনুসরণ করে চলতে হয়। এ দলের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় নিয়ম মাফিক। এখানে নিয়ম-কানুনের আধিক্য বেশি থাকে। রাজনৈতিক দল, শ্রেণিকক্ষ প্রভৃতি এ দলের উদাহরণ।
৬. অনানুষ্ঠানিক দল : কিছু লোক যখন এক বা একাধিক সাধারণ মূল্যবোধের ভিত্তিতে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য সংগঠিত হয় তখন তাকে অনানুষ্ঠানিক দল বলা হয়। এ দলের সদস্যভুক্তি ও কার্যাবলী রীতিমাফিক পরিচালিত হয় না। সাধারণত এ দল নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা না দেয়া পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। এছাড়াও স্থায়ী, অস্থায়ী, ব্যক্তিগত, নৈর্ব্যক্তিক, উন্নত, অনুন্নত, উলম্ব, আনুভূমিক, সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক, সমাজবিরোধী, স্বেচ্ছামূলক, অস্বেচ্ছামূলক, স্বাতন্ত্রসূচকসহ নানা ধরনের দল রয়েছে।
মানুষ সামাজিক জীব। দলবদ্ধ ছাড়া মানুষের পক্ষে একা বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। বর্তমান জটিল সমাজব্যবস্থায় দল ছাড়া সামাজিক জীবন কল্পনা করা যায়না। মানবজীবনের অস্তিত্বের প্রয়োজন ও অনিবার্য কারণে দল একান্ত প্রয়োজন। দল হলো একাধিক লোকের সম্মিলিত রূপ। একাধিক লোক যখন সুনির্দিষ্ট কিছু সামাজিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একত্রিত হয়ে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয় তাকে সামাজিক দল বলে। দলের সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য এবং নীতিমালা থাকে যা দলের সকল সদস্যকে মেনে চলতে হয়। দল বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হলো: ক) প্রাথমিক দল, খ) গৌণ বা মাধ্যমিক দল, গ) অন্তঃদল, ঘ) বহিঃদল, ঙ) আনুষ্ঠানিক দল, চ) অনানুষ্ঠানিক দল প্রভৃতি।
দল সমাজকর্মের ধারণা
পেশাদার সমাজকর্মের অন্যতম মৌলিক পদ্ধতি হলো দল সমাজকর্ম। সাধারণত দলীয় সদস্যদের সাথে শৃঙ্খলাপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক বা পরিকল্পিত উপায়ে কাজ করার বিশেষ পদ্ধতি হলো দল সমাজকর্ম। সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা, নৈপূণ্য ও পেশাগত মূল্যবোধ অনুসরণ করে দলগত পর্যায়ে সমস্যার সমাধান এবং দলীয় উন্নয়নে সেবাদান প্রক্রিয়াকে বলা হয় দল সমাজকর্ম।
জি. কনকপা এর মতে, দল সমাজকর্ম সমাজকর্মের এমন একটি পদ্ধতি যা উদ্দেশ্যপূর্ণ দলীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যক্তিকে তার সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টিগত সমস্যার অধিকতর কার্যকরী মোকাবিলায় সহায়তা করে।
এইচ. বি ট্রেকার বলেন, দল সমাজকর্ম হলো দল সমাজকর্মী কর্তৃক দলের সদস্যদের সাহায্য করার এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সমাজকর্মী দলীয় কার্যাবলীতে সদস্যদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাতে তারা নিজেরা পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হয়ে এবং তাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যক্তি, দল ও সমাজের উন্নতি বিধানের সুযোগ লাভ করতে পারে।
সুতরাং বলা যায় যে, দল সমাজকর্ম সমাজকর্মের এমন একটি মৌলিক পদ্ধতি, যা উদ্দেশ্যপূর্ণ দলীয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দলের সদস্যদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যাতে দলীয় উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী একাধারে সাহায্যকারী ও সক্ষমকারী হিসেবে কাজ করেন।
To German social workers, Konopka is considered the “mother of social group work.” Gisela Konopka কে দলীয় সমাজকর্মের জনক/জননী/মাতা হিসেবে ধরা হয়। তার বিখ্যাত বইয়ের নাম Social Group Work: a Helping Process যা ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া, Harleigh Bradley Trecker ১৯৫৫ সালে Social Group Work, Principles and Practices বইটি লিখেন।
দল সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্য
ক। সামাজিক দল: দুই বা ততোধিক ব্যক্তির
সমষ্টি,যারা পরস্পর সম্পতর্কিত হয়ে একই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেষ্টা করে তাকে সামাজিক দল
বলে।
খ। দলীয় প্রক্রিয়া:
কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের নিমিত্তে দল সমাজকর্মীরা নির্দেশনার
মাধ্যমে দলের সদস্যদের স্বাধীন বা মুক্ত আন্তঃক্রিয়াই দলীয় প্রক্রিয়া।
গ। দলীয় গতিশীলতা:
দলীয় মিথস্ক্রিয়ার প্রভাবে দলের গঠন কাঠামো এবং সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে
যে ধারাবাহিক পরিবর্তন চলতে থাকে তাকে দলীয় গতিশীলতা বলে।
ঘ। দলীয় আন্তঃক্রিয়া:
দলীয় লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে এর সদস্যরা একে অপরের সাথে যে ভাবের আদান-প্রদান করে
তাকে সামগ্রিকভাবে দলীয় আন্তঃক্রিয়া বলে।
ঙ। দলীয় দ্বন্দ্ব:
দলের অভ্যন্তরে দলীয় কার্যক্রম,সিন্ধান্ত,নেতৃত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে সদস্যরা পরস্পরের
প্রতি যে সংঘাতমূলক,প্রতিযোগিতা,প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আচরণ প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান প্রদর্শন
করে তাকে দলীয় দ্বন্দ্ব বলে।
চ। আত্নীকরণ: সমাজে
যখন বিপরীতধর্মী দুই বা ততোধিক সংস্কৃতি বা ব্যক্তির সামজ্ঞস্য ঘটে তখন তাকে আত্নীকরণ
বলে।
ছ। প্রতিযোগিতা: কোন
রকম বাধা প্রদান ছাড়া কিছু মূল্যবোধ ও নীতির ভিত্তিতে লক্ষ্য অর্জনের পারস্পরিক প্রচেষ্টা
হল প্রতিযোগিতা।
জ। সহযোগিতা: কোন
সাধারণ উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করাই হল সহযোগিতা।
ঝ। কর্মসূচি পরিকল্পনা: এমন এক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেখানে কর্মসূচি সংক্রান্ত সিন্ধান্ত গ্রহণের সময় সমাজকর্মী তার নিজস্ব স্বার্থ ও ইচ্ছা দলের উপর চাপিয়ে না দিয়ে সদস্যদের নিজস্ব স্বার্থ ও চাহিদা অনুসারে কর্মসূচি প্রণয়নে সহায়তা করে থাকে তাকেই কর্মসূচি পরিকল্পনা বলে।
ঞ। নেতৃত্ব: একজন ব্যক্তির এমন একটি গুনাবলী যার মাধ্যমে অন্যদের উপর আধিপত্য করার ক্ষমতা রাখে তাকেই নেতৃত্ব বলে।
ট। নেতা: যিনি দল পরিচালনা,দলীয় সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ,দলীয় লক্ষ্যাঅর্জনের জন্য সদস্যদেরকে সংগঠিত এবং দলে উন্নয়নের দিক নির্দেশনা প্রদান করেন তাকে নেতা বলা হয়।
ঠ। কাউন্সেলিং: এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আনয়ন করা হয় এবং এই পরিবর্তনের ফলে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছে যায়।
ড। দলীয় থেরাপি: পেশাদার
ব্যক্তি কর্তৃক সুনির্দিষ্ট ও নিয়মিত দলীয় আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় সদস্যদের ব্যক্তিগত
বা সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমকার উন্নয়নে ও দুর্দশা লাঘব করাকে দলীয় থেরাপি বলে।
ঢ। গ্রুপ লিপিবদ্ধকরণ/গ্রুপ
রেকডিং: দলের সদস্যদের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় তথ্য এবং এ কাজে নিয়োজিত দল সমাজকর্মীর
প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সংরক্ষণ করা এবং একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দল সমাজকর্ম অনুশীলন অব্যাহত
রাখাকে নথি লিপিবদ্ধকরণ বলে।
দল সমাজকর্মের উপাদান
যে সকল বিষয় নিয়ে দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় তাই হলো দল সমাজকর্মের উপাদান। নিচে দল সমাজকর্মের উপাদানগুলো আলোচনা করা হলো :
ক. সামাজিক দল : দল সমাজকর্মের প্রাণ বলা হয় দলকে। দল হলো একাধিক ব্যক্তি দ্বারা গঠিত সমাজিক একক। যারা নির্দিষ্ট সাধারণ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। দল সমাজকর্মে সদস্যদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দলের আকার সীমিত হতে হয়।
খ. দল সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠান : যে সকল প্রতিষ্ঠান দলীয় সেবাদানে নিয়োজিত তাই হলো দল সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠান। দল সমাজকর্মী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে দলীয় লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে থাকে। দল সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন: সরকারি, বেসকারি, একমুখী (কার্যক্রমভিত্তিক, বহুমুখী কার্যক্রমভিত্তিক, প্রত্যক্ষ) সেবাদানকারী, পরোক্ষ সেবাদানকারী প্রভৃতি। দল সমাজকর্ম প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই দলের চাহিদা পূরণে সক্ষম হতে হবে। এছাড়া দলের প্রয়োজন বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা, দলকে সেবা প্রদানের জন্য পেশাদার ও অপেশাদার কর্মীবাহিনী সমৃদ্ধ এবং পেশাগত মূল্যবোধ ও নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়।
গ. দল সমাজকর্মী : দল সমাজকর্মে দল সমাজকর্মী হলো মূল চাবিকাঠি। তিনি এক্ষেত্রে একাধারে সাহায্যকারী ও সক্ষমকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন। দল সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা, নীতিমালা, কৌশল প্রভৃতি প্রয়োগে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিই হলেন দল সমাজকর্মী। তিনি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে দলকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করেন। একজন দলসমাজকর্মীকে অবশ্যই দলীয় সদস্যদের সাথে উদ্দেশ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, দলীয় অবস্থা বিশ্লেষণ, দলের সাথে মেলামেশা, দলীয় অনুভূতি ব্যবহার করে কার্যক্রম পরিচালনা, প্রতিষ্ঠান ও সমষ্টির সম্পদ ব্যবহারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ হতে হয়।
ঘ. দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া : কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে দল সমাজকর্মী পরিচালিত হয় । যে কৌশলের মাধ্যমে দলের সদস্যদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল উপায়ে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন তাকে দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া বলে। দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া তখনই কার্যকর হয়, যখন সমাজকর্মী ব্যক্তি ও দলের উন্নয়নে দলীয় সদস্যদের মধ্যে সংঘটিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার কতগুলো ধাপ বা স্তর রয়েছে। যথা: দল গঠন, মূল্যায়ন ও যাচাই, লক্ষ্য নির্ধারণ ও সংযোগ স্থাপন, পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং মূল্যায়ন ও সমাপ্তি।
দল সমাজকর্মের নীতিমালা
দল সমাজকর্ম অনুশীলনে সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতে হয় যা সুশৃঙ্খল, পরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে দল সমাজকর্ম পরিচালনায় সহায়তা করে। দল সমাজকর্মের নীতিমালা নিচে আলোচনা করা হলো :
১. পরিকল্পিত দলগঠন নীতি : দল সমাজকর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো দল। দল সমাজকর্মীকে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানের নীতি অনুসারে পরিকল্পিত দলগঠন করে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য দল সমাজকর্ম কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হয়। উত্তম পরিকল্পিত দলগঠন যথাযথ কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং দলীয় সন্তুষ্টি লাভে সহায়তা করে।
২. সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের নীতি : দলের সদস্যদের কল্যাণে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে হয় । উদ্দেশ্য ব্যতীত কোনো কার্যক্রমই সফল হয় না । সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে দলীয় সদস্যদেরকে বিশেষভাবে দায়িত্ববোধ সম্পন্ন করে তোলে। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য নির্ধারণের জন্য সমাজকর্মীকে কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। যেমনÑ দলীয় সদস্যদের চাহিদা, প্রত্যাশা, সমস্যা, সম্পদ, সীমাবদ্ধতা, সক্ষমতা, দল ও প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, দলীয় সদস্যদের মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তসম্পর্কের প্রকৃতি।
৩. দল-কর্মীর মধ্যে সম্পর্কের নীতি : দল সমাজকর্মে সমাজকর্মী-দল সম্পর্ক একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। দল সমাজকর্মে সমাজকর্মী ও দলের মধ্যে অবশ্যই উদ্দেশ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে । সমাজকর্মী ও দলের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের ফলে কার্যকর উদ্দেশ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। দল সমাজকর্মী ও দলীয় সদস্যরা পরস্পরকে কীভাবে গ্রহণ করে তার উপর এ সম্পর্কের কার্যকরিতা অনেকটা নির্ভরশীল। এ সম্পর্ককে কার্যকর করার জন্য অবশ্যই দল সমাজকর্মীকে দলীয় সদস্যদেরকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করা উচিত। তেমনি দলীয় সদস্যরাও দল সমাজকর্মীকে আন্তরিকতা ও উষ্ণতার সাথে গ্রহণ করবে। আর এভাবেই পেশাগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে।
৪. ধারাবাহিক স্বাতন্ত্রীকরণ নীতি : সম্পদ, সামর্থ্য, বৈশিষ্ট্য, নীতি, মূল্যবোধ, লক্ষ্যভেদে যেমন প্রতিটি দল আলাদা তেমনি দলের প্রত্যেকটি সদস্যও স্বতন্ত্র এবং প্রত্যেকেই এই স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি চায়। স্বাতন্ত্রীকরণ দল সমাজকর্ম অনুশীলনে সাফল্য লাভের অন্যতম উপায়। তাই দল সমাজকর্ম অনুশীলনে দল ও দলীয় সদস্যদের ক্ষেত্রে এ নীতি অনুসরণ করা দল সমাজকর্মীর জন্য আবশ্যক।
৫. নির্দেশিত দলীয় আন্তক্রিয়ার নীতি : দল একটি গতিশীল সত্ত্বা। দলকে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে দলীয় সদস্যদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী দলীয় সদস্যদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার গতি ও প্রকৃতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন যা দল সমাজকর্মের অন্যতম নীতি। দল সমাজকর্মে দলীয় সদস্যদের পারস্পরিক আন্তক্রিয়া গঠনকারী উপাদানসমূহ হলোÑ দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা, সম্মতি, আনুগত্য, প্রতিপত্তি, অভিযোজন ইত্যাদি।
৬. দলীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি : দল একটি স্বতন্ত্র সত্ত্বা। সতন্ত্র সত্ত্বা হিসেবে দলের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আপন বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী দলকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে দল সমাজকর্মী দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি, দলের সক্ষমতা বৃদ্ধি, দলীয় সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা, সদস্যদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ, সদস্যদের মধ্যে উন্নয়নের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি এবং দায়িত্ববোধ ও স্বাধীনতার চেতনা সঞ্চারে সহায়তা করবে।
৭. নমনীয় কর্মমুখী প্রতিষ্ঠানের নীতি : এই নীতিটি প্রতিষ্ঠান ও দল উভয় ক্ষেত্রে অনুশীলন জরুরি। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো নমনীয় হওয়া প্রয়োজন, যাতে দলীয় ও সামাজিক পরিবর্তন এবং প্রত্যাশার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নতুন সেবাকার্যক্রম গ্রহণ, পুরাতন কর্মসূচির সংশোধন এবং সাংগঠনিক কাঠামোর পরিবর্তন আনা যায়। অন্যদিকে দলের সাংগঠনিক কাঠামোও নমনীয় হতে হবে, যেন সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে নেতৃত্বের পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় এবং দলের উন্নতির জন্য পরিবর্তজনিত অবস্থার সাথে দল খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়।
৮. প্রগতিশীল কর্মসূচি গ্রহণ নীতি : প্রত্যেকটি দলের লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম উপায় হলো সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী কর্মসূচি প্রণয়ন। দল সমাজকর্মে কর্মসূচি প্রণয়নে দলীয় সদস্যদের আগ্রহ, সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা, চাহিদা ও যোগ্যতা বিবেচনায় আনতে হয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী দলীয় সদস্যদের মতামত প্রকাশের মাধ্যমে তাদের দ্বারা সময়োপযোগি কর্মসূচি প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন।
৯. সম্পদের সদ্ব্যবহার নীতি : এই নীতির মাধ্যমে দলের লক্ষ্য অর্জন ও সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উৎস্য হতে প্রাপ্ত বস্তুগত ও অবস্তুগত সম্পদের (দলীয় সম্পদ, প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, সমষ্টির সম্পদ) সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।
১০. মূল্যায়ন নীতি : দল সমাজকর্ম একটি গতিশীল প্রক্রিয়া যা পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থা ও পরিবেশ অনুযায়ী সেবা প্রদান করে থাকে। এ কারণে দল সমাজকর্ম কার্যক্রমের সাফল্য, ব্যর্থতা, সক্ষমতা, দুর্বলতা প্রভৃতি বিষয়ে মূল্যায়ন প্রয়োজন হয়। এই মূল্যায়ন দল সমাজকর্মের কার্যকারিতা যাচাইয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতে দলের সদস্যদের জন্য যথাযথ কর্মকৌশল নির্ধারণে সহায়তা করে।
দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া
দলীয় আন্তঃক্রিয়ার ফলে দলে সে গতিশীলতা সৃষ্টি হয় তাকে দলীয় প্রক্রিয়া বলা হয়। আর দলের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে যখন সমাজকর্মী দলকে সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে পরিচালনা করেন, তখন তাকে দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া বলা হয়। দল সমাজকর্মের দল সর্বদা উদ্দেশ্যমুখী। সমাজকর্মী এক্ষেত্রে দলের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য হস্তক্ষেপ করে থাকেন।
এইচ. বি ট্রেকারের মতে, দল সমাজকর্মী যখন ব্যক্তিগত ও দলগত উন্নয়নে দলীয় সদস্যদের আন্তঃক্রিয়াকে সচেতন ভাবে নির্দেশনা ও পরিচালনা করেন তখন তাকে দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া বলা হয়।
সূতরাং বলা যায় দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া হলো দলীয় প্রক্রিয়ার পরিবর্তিত ও রূপ, যেখানে দল সমাজকর্মী দলের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দলের সদস্যদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করে থাকেন।
দল সমাজকর্ম বিশ্লেষণ করলে এর দু’টি বিশেষ দিক দেখতে পাওয়া যায় । যথা: উন্নয়নমূলক দিক ও প্রতিকারমূলক দিক। যখন দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় সদস্যদের কার্যকর ও গঠনমূলক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতা ও সামর্থ বৃদ্ধিও প্রচেষ্টা চালানো হয় তাকে উন্নয়নমূলক দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া বলে। আর যখন দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় দ্বন্দ্ব ও অসম প্রতিযোগিতা দূরীকরণের জন্য দলীয় সদস্যদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাকে প্রতিকারমূলক দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া বলা হয়।
দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়ার পর্যায়সমূহ
দলের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে দলকে কতগুলোা পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। প্রতিটি পর্যায়ে সমাজকর্মী তার জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও মূল্যবোধ দ্বারা দলকে সহায়তা করেন। পর্যায়সমূহ হলো :
১। গঠন পর্যায় : এটি হলো দল গঠনের প্রাথমিক পর্যায়। এ পর্যায়ে দলের সদস্য সংগ্রহ করা হয়। এ পর্যায়ে ব্যক্তি কোনো দলে অন্তর্ভুক্ত হবে, দলে তার করণীয় কী, দলীয় আচরণ কী হবে কিছুই সে জানতে বা বুঝতে পারেনা। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী ব্যক্তির পছন্দ ও ইচ্ছানুযায়ী দলে অন্তর্ভুক্ত হতে সহায়তা করেন।
২। দুর্যোগ পর্যায় : এটি দলের বিকাশ পর্যায়। এ পর্যায়ে দল গড়ে উঠতে পারে আবার ভেঙ্গেও যেতে পারে। সে জন্য এ পর্যায়কে দুর্যোগ পর্যায় বলা হয়। এ পর্যায়ে দলের প্রত্যেক সদস্য তার নিজের অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে এবং দৃঢ় অবস্থান ও নেতৃত্বের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী দলের সদস্যদেরকে বাস্তববাদী হওয়ার পরামর্শ দেন এবং হতাশাগ্রস্তদেরকে উৎসাহ দেন।
৩। আদর্শিক পর্যায় : এ পর্যায়ে দল একটি সাংগঠনিক রূপ নেয়। দলের সদস্যদের মধ্যে বিশ্বাস, সংহতি, অন্তরঙ্গতা, আমাদের দল প্রভৃতি মনোভাবের বিকাশ ঘটে। দলের উদ্দেশ্য, ভূমিকা, মূল্যবোধ ও কর্মসূচি নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী দলীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দলীয় সদস্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন।
৪। কার্যকর পর্যায় : এ পর্যায়ে দল সম্পদশালী ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। দলের লক্ষ্য অর্জন ও সমস্যা সমাধানে দলীয় সদস্যদের জ্ঞান, দক্ষতা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে। দলের বিশ্বাস, সংহতি ও সাংগঠনিক কাঠামো সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা পায়।
৫। চূড়ান্ত পর্যায় : এ পর্যায়ে দল প্রণীত বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। এক্ষেত্রে দলের সদস্যদের চাহিদা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয় এবং তা বাস্তবায়নে দলের সদস্যদের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
ইংরেজিতে পড়ুনঃ Stages of Social Work Group Formation
দল সমাজকর্মের দল সর্বদা উদ্দেশ্যমুখী। এ উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে যখন দল সমাজকর্মী দলীয় সদস্যদের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াকে সুপরিকল্পিত উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করেন তখন তাকে দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া বলা হয়। দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়া কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ধাপ বা পর্যায় অতিক্রম করে সম্পন্ন হয়। যেমনঃ ক) গঠন পর্যায়, খ) দূর্যোগ পর্যায়, গ) আদর্শিক পর্যায়, ঘ) কার্যকরী পর্যায় এবং ঙ) চূড়ান্ত পর্যায়।
দল সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া
দলের সমস্যা সমাধানে দল সমাজকর্মী যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাই হলো দলীয় সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া।
জি. কনকপা ও ডব্লিউ. এ. ফ্রিডল্যান্ডার এর মতে, দল সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় নিন্মোক্ত স্তর বা ধাপসমূহ অনুসরণ করতে হয়। যথা :
১. অনুধ্যান : দলের যে কোনো সমস্যা মোকাবিলার জন্য দল সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী সরাসরি অংশগ্রহণ ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে দলের স্বরূপ, প্রকৃতি, দলের অবস্থান, পরিচিতি, দলীয় সদস্যদের বৈশিষ্ট্য, দলীয় সম্পদ ও সামর্থ্য, দলীয় প্রক্রিয়া ও সমস্যাসমূহ, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও তার প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। এ স্তরকে তথ্যানুসন্ধানও বলা হয়ে থাকে ।
২. সমস্যা নির্ণয় : এ স্তরে দলের সমস্যা ও দলীয় সদস্যদের চাহিদা নিরূপণ করা হয়। এক্ষেত্রে অনুধ্যানে প্রাপ্ত তথ্যাবলী সমাজকর্মী তার জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে দলের সমস্যা নির্ণয় ও দলীয় সদস্যদের চাহিদা নিরূপণ এবং সমস্যা সমাধান ও চাহিদা পূরণের জন্য বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়নের স্তরও বলা হয়ে থাকে।
৩. সমাধান : অনুধ্যান ও সমস্যা নির্ণয়ের প্রেক্ষিতে দলীয় সমস্যা সমাধান বা সেবাদানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে দলের গঠন, প্রকৃতি, দলীয় সম্পদ, শক্তি-সামর্থ্য, দলের উদ্দেশ্য, দলীয় সদস্যদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি বিবেচনায় এনে সেবা প্রদান করা হয়। সাধারণত যে সকল পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে দল সমাজকর্মী দলীয় সমস্যা সমাধান করে থাকেন সে গুলো হলো: ক) একনায়কত্ব বা প্রভূত্বব্যঞ্জক পদ্ধতি, খ) দৃষ্টান্তমূলক পদ্ধতি, গ) শিক্ষামূলক পদ্ধতি, ঘ) উদ্দেশ্যমূলক পদ্ধতি এবং ঙ) সক্ষমকারী পদ্ধতি।
৪. মূল্যায়ন : দল সমাজকর্ম প্রক্রিয়ায় সেবাদানের সর্বশেষ স্তর হলো মূল্যায়ন। এ স্তরে সেবাদানের সফলতা ও ব্যর্থতা নিরূপণ করা হয়। অর্থাৎ প্রদেয় সেবা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হয়েছে তা যাচাই করা হয়। অন্যদিকে যদি সেবাব্যবস্থা ব্যর্থ হয় সে ক্ষেত্রে তার কারণ নির্ণয় করে পূণরায় সেবা প্রদান করা হয়। দল সমাজকর্মের সেবাদান প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক ও মেয়াদী এ দুধরনের মূল্যায়ন করা হয়। দল একটি গতিশীল সত্ত্বা। দলীয় সদস্যদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে দলে এই গতিশীলতা সৃষ্টি হয়। দলের সদস্যদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী দলের সমস্যা সমাধানে যে সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন তাই হলো দলীয় সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়া। দলীয় সমস্যা সমাধানে কয়েকটি ধাপ বা পর্যায় অনুসরণ করতে হয়। তা হলো: ক) অনুধ্যান, খ) সমস্যা নির্ণয়, গ) সমাধান এবং ঘ) মূল্যায়ন।
ইংরেজিতে পড়ুনঃ Group Dynamics, Group Process and Social Work Process
দল সমাজকর্মীর ভূমিকা
দল একটি গতিশীল সত্ত্বা। এর অন্যতম উপাদান হলো সমাজকর্মী যার ভূমিকা বিভিন্নমূখী। একজন দল সমাজকর্মী কখনো নেতৃত্বদানকারী, কখনো নিয়ন্ত্রণকারী, কখনো মধ্যস্থতাকারী, কখনো সাহায্যকারী আবার কখনো কর্মসূচি প্রণয়নকারীর ভূমিকা পালন করে থাকেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই দল সমাজকর্মীকে প্রতিষ্ঠান এবং দলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি, নীতিমালা, সম্পদ, সামর্থ্য, দলীয় সদস্যদের চাহিদা ইত্যাদির দিকে খেয়াল রাখতে হয়। নিচে দল সমাজকর্মীর ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. দলের সদস্যদের ভূমিকা ও দায়িত্ব নির্ধারণ : দলের লক্ষ্য অর্জনে দলের প্রত্যেক সদস্যকে কোনো না কোনো ভূমিকা পালন করতে হয়। প্রত্যেক সদস্যের পারস্পরিক সহযোগিতায় যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই দলীয় লক্ষ্য অর্জিত হয়। সমাজকর্মী দলের সদস্যদের কার কী ভূমিকা হবে তা নির্ধারণে সহায়তা করেন।
২. কার্যকর দলীয় কাঠামো গঠন : প্রত্যেক দলেরই একটি সাংগঠনিক কাঠামো থাকে যা দলীয় লক্ষ্য ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ দলীয় কাঠামো সহজেই দলকে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সমাজকর্মী দলকে তার সাংগঠনিক কাঠামো গঠনে সহায়তা করে থাকেন।
৩. বাস্তবধর্মী উদ্দেশ্য ও আদর্শ নির্ধারণ : কতিপয় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে দল গঠিত হয়। কিন্তু লক্ষ্য যদি বাস্তবমুখী না হয় তবে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। সেজন্য সমাজকর্মী তার জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে দলকে বাস্তবধর্মী লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করে থাকেন।
৪. কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন : প্রত্যেক দলের লক্ষ্য ও দল উপযোগী কর্মসূচি থাকে। দল সমাজকর্মী এক্ষেত্রে দলের সদস্যদের আশা-আকাক্সক্ষাকে মূল্য দিয়ে দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও এজেন্সির নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়ন উপযোগী দলীয় কর্মসূচি নির্ধারণ করে থাকেন।
৫. সম্পদের সদ্ব্যবহার : সাধারণভাবে প্রাপ্ত বস্তুগত ও অবস্তুগত সম্পদ, দলের সম্পদ এবং প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ও সমষ্টির সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে তা যথাযথভাবে ব্যবহারের উপর দলের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অনেকটাই নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী দলকে এমনভাবে সহায়তা করেন যাতে তারা তাদের বস্তুগত ও অবস্তুগত সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে।
৬. গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা : দলের সার্বিক উন্নয়নে যোগ্য নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম এবং নেতৃত্ব অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীর কর্তব্য হলো দলকে এমনভাবে সহায়তা করা যাতে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত থাকে, সকলের অংশগ্রহণ ও মতামত গুরুত্ব পায়, সঠিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠে এবং দলের সদস্যরা কার্যকর সিন্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়।
৭. দ্বন্দ্ব দূরীকরণ : দলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত স্বাভাবিক বিষয়। কোনো সক্রিয় দলে উপদল সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দ্বন্দ্ব স্থায়ী হলে তা দলের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মূল কারণ হলো বঞ্চনা, নির্যাতন, অসন্তোষ, ক্ষোভ, ব্যক্তিত্বের পার্থক্য প্রভৃতি। সমাজকর্মী অসন্তোষ দূর করে বন্ধুত্বপূর্ণ ও পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টিতে দলকে সহায়তা করে থাকেন।
৮. প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা প্রদান : দলের সুষ্ঠু গতিশীলতার জন্য প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য, কার্যক্রম, সুযোগ-সুবিধা, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি সম্পর্কে সদস্যদের পূর্ণজ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। এসব জ্ঞান থাকলে দলের সদস্যদের পক্ষে নিজ নিজ ভূমিকা পালন যেমন সহজতর হয় তেমনি তাদের প্রত্যাশাও বাঞ্ছিত সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। সমাজকর্মী সদস্যদের এসব বিষয়ে জ্ঞানদান করে থাকেন।
৯. শিক্ষামূলক ভূমিকা : দল সমাজকর্মীকে দলের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অধিকাংশ সময় শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। সমাজকর্মী নিঃসন্দেহে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান, দক্ষতা ও কৌশল সম্পর্কে অবহিত। দলের সদস্যদের যেসব বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব রয়েছে সেসব দিক সম্পর্কে তিনি তাদের জ্ঞানদান এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ ও ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে দলকে সহায়তা করে থাকেন।
১০. সন্তোষজনক দলীয় পরিবেশ সৃষ্টি : অনুকূল ও সন্তোষজনক পরিবেশ ছাড়া দলের সদস্যদের সত্যিকার চাহিদা পূরণ ও লক্ষ্য অর্জিত হয়না। সেজন্য সমাজকর্মীর ভূমিকা হলো দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কলহ ও বিবাদ দূর করে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে পারস্পরিক সহযোগিতা ও স্বাভাবিক ভূমিকা পালন সহজতর হয়।
১১. প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করা : সমাজকর্মী যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করাও তার কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। জনগণ ও সমাজের কাছে তার প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও কার্যক্রম তুলে ধরা তার অন্যতম দায়িত্ব। পরিচিতি তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি সামাজিক সমর্থন আদায় করেন এবং সমষ্টির সম্পদ ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা আদায়ে দলকে সহায়তা করে থাকেন।
দল সমাজকর্মী মূলত দলের চাবিকাঠি। দলের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্য দলের সদস্যদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সদস্যদের চাহিদা পূরণ ও দলীয় সমস্যা সমাধানে দল সমাজকর্মী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। দলে একজন সমাজকর্মীর ভূমিকা বহুমুখী। তিনি কখনো নেতৃত্বদানকারী, কখনো নিয়ন্ত্রণকারী, কখনো সাহায্যকারী আবার কখনো বা কর্মসূচি প্রণয়নকারীর ভূমিকা পালন করে থাকেন। একজন সমাজকর্মী সাধারনত যেসকল ভূমিকা পালন করে থাকেন তা হলো: ১) কার্যকর দলীয় কাঠামো গঠন, ২) দলের সদস্যদের ভূমিকা ও দায়িত্ব নির্ধারণ, ৩) বাস্তবধর্মী উদ্দেশ্য ও আদর্শ নির্ধারণ, ৪) কর্মসূচি প্রণয়ন, ৫) সম্পদের সদ্ব্যবহার, ৬) গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা, ৭) দ্বন্দ্ব দূরীকরণ, ৮) প্রতিষ্ঠানের সুযোগ সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা প্রদান, ৯) শিক্ষামূলক ভূমিকা, ১০) সন্তোষজনক দলীয় পরিবেশ সৃষ্টি, ১১) প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে দল সমাজকর্মের প্রয়োগক্ষেত্র
বাংলাদেশে দল সমাজকর্মের প্রয়োগক্ষেত্র ব্যাপক ও বিস্তৃত। সম্পদের সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূল অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে বাংলাদেশে দল সমাজকর্মের ক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দল সমাজকর্মের প্রয়োগক্ষেত্র নিচে আলোচনা করা হলো :
১. কৃষি উন্নয়ন : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি উন্নয়নের সাথে এদেশের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। এদেশের কৃষি ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। এসমস্ত সমস্যা দূর করে দরিদ্র কৃষক শ্রেণিকে সংগঠিত করে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব। এদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক কর্মসূচি রয়েছে যেখানে দল সমাজকর্ম প্রয়োগ করে কৃষির উন্নয়ন করা হচ্ছে। যেমনঃ বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, ব্র্যাক, প্রশিকা প্রভৃতি।
২. সমবায় সমিতি গঠন : বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সমবায় কর্মসূচি। সমবায় কর্মসূচির সাথে উন্নয়নের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আমাদের দেশে বিশেষ করে দরিদ্র ও অদক্ষ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সমবায় কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে দল সমাজকর্মের অভিজ্ঞতা, কৌশল ও দক্ষতা প্রয়োগ করে গণমুখী সমবায় আন্দোলনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়।
৩. নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা দূরীকরণ : বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা অন্যতম সামাজিক সমস্যা। এসব সমস্যা দূর করার জন্য বয়স্ক ও সামাজিক শিক্ষাদান একান্ত প্রয়োজন। দল সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা দূর করা সম্ভব।
৪. পরিবার পরিকল্পনা : পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্র, অশিক্ষিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত বেশি। আনুষ্ঠানিকভাবে দল সমাজকর্ম প্রয়োগ করে এদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল এবং ছোট পরিবার গঠনের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা সম্ভব।
৫. বেকারত্ব দূরীকরণ : বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকার। এদের মধ্যে একটি বড় অংশই হলো মৌসুমী বেকার। পরিকল্পিত ও সংগঠিত দলীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্থানীয় কাঁচামাল ও চাহিদানির্ভর ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প স্থাপনের মাধ্যমে যেমন মৌসুমি ও ছদ্ম বেকারদের খ-কালীন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, তেমনি বিপুল পরিমাণ শ্রম শক্তিকে উৎপাদনমুখী কাজে লাগানো সম্ভব।
৬. নারীকল্যাণ : বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। কিন্তু তারা নানাভাবে বৈষম্য এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার। উৎপাদন ও উন্নয়ন কর্মকা-ে এদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি নেই বললেই চলে, যদিও বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসে নারী শ্রমের মাধ্যমে যেমন: গার্মেণ্টস শিল্প, কৃষিকাজ ইত্যাদি। দলীয় পর্যায়ে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান ও সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে সাধারণ নারীদের যেমন সচেতন জনশক্তিতে পরিণত করে তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যায়, তেমনি দুঃস্থ, অসহায় দরিদ্র নারীদেরও সমাজে সুষ্ঠুভাবে পুণর্বাসন করা সম্ভব।
৭. যুবকল্যাণ : যুব অসন্তোষ বাংলাদেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। এর ফলে উৎপাদনশীল শ্রম শক্তির যেমন অপচয় হচ্ছে তেমনি সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে বিপথগামী যুবসমাজকে কর্মমুখী ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে উৎসাহিত করতে দল সমাজকর্মের অভিজ্ঞতা ও কৌশল প্রয়োগ করা যায়।
৮. পরিবারকল্যাণ : পরিবার হলো সমাজের প্রাথমিক দল। আর্থ-সামাজিক প্রতিকূল অবস্থার কারণে এদেশে পরিবারগুলো সুষ্ঠুভাবে সামাজিক ভূমিকা পালন করতে পারেনা। তাই সুষ্ঠু ও কার্যকর পরিবার গঠন, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দল সমাজকর্মের কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৯. শিশু সদন বা শিশু পরিবার : বাংলাদেশের শিশু পরিবারগুলোতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ছেলে-মেয়েরা বসবাস করে। দল সমাজকর্ম প্রয়োগ করে এদের মধ্যে সখ্যতার বন্ধন সৃষ্টি করা যায়। এছাড়া শিশুদের উপযোগী নানা দলীয় কাজের মাধ্যমে এদের মধ্যে দায়িত্বশীল নাগরিকত্ববোধ এবং স্বনির্ভর মনোবৃত্তি সৃষ্টি করাও সম্ভব যা তাদের পরবর্তী জীবনে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
১০. শ্রমকল্যাণ : শ্রম অসন্তোষ দূরীকরণে দল সমাজকর্ম গুুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের দেশের শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে সম্প্রীতি ও দলীয় সংহতির অভাব থাকায় মালিক শ্রেণি তাদের নানাভাবে বঞ্চিত করার সুযোগ পায়। দল সমাজকর্মের কৌশল প্রয়োগ করে শ্রমিকদের সংগঠিত করে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সহায়তা করা যেতে পারে।
১১. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে দল সমাজকর্ম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যকার উচ্ছৃঙ্খলতা রোধ, ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন,প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিনষ্টকরণ প্রভৃতি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত রাখতে দল সমাজকর্মের কৌশল প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ভ্রমণ, চিত্তবিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়।
১২. কিশোর অপরাধ সংশোধন : কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের ক্ষেত্রে দল সমাজকর্মের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে বোরস্টাল স্কুল ও কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে সংশোধনের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যতম দেশ। সম্পদের সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে এখানে নানা সমস্যা বিদ্যমান। এ কারণে বাংলাদেশে দল সমাজকর্মের প্রয়োগক্ষেত্র ব্যাপক ও বিস্তৃত। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যেসকল ক্ষেত্রে দল সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোঃ ১) কৃষি উন্নয়ন, ২) সমবায় কর্মসূচি, ৩) নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা দূরীকরণ, ৪) পরিবার পরিকল্পনা, ৫) বেকারত্ব দূরীকরণ, ৬) নারীকল্যাণ, ৭) যুবকল্যাণ, ৮) পরিবারকল্যাণ, ৯) শিশু পরিবার, ১০) শ্রমকল্যাণ, ১১) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ১২) কিশোর অপরাধ সংশোধন।