গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা (ডায়েট চার্ট)

গর্ভকালীন যেসব খাওয়া যাবে না

ক) অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যালরিবহুল শর্করাযুক্ত খাবার যেমন মিষ্টি খাবার, ফাস্টফুড, পানীয়, তেলের পিঠা খাওয়া যাবে না। কারণ এগুলো গর্ভবতী মায়েদের ওজন ও রক্তচাপ বাড়ানোর পাশাপাশি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।


খ) চা-কফি অর্থাৎ ক্যাফেইন যুক্ত খাবার আয়রন শোষণে বাধা দেয় যার ফলে মা এবং শিশুর উভয়ের পরবর্তীতে রক্তস্বল্পতা জনিত সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়।


গ) কামরাঙ্গা, আনারস বা কাঁচা পেঁপেতে কিছু এনজাইম থাকে যা ১ম ত্রৈমাসিকে ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে।


ঘ) অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। কারণ এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি পায়ে পানি আসা বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ফুলে যেতে পারে।


ঙ) ধোয়া নয় বা জীবাণুমুক্ত নয়, এমন ফল এড়িয়ে চলুন। বাজারে বিক্রি হওয়া ফলে বিভিন্ন কীটনাশক দেয়া থাকে। তাই অবশ্যই এগুলো ধুয়ে ফেলতে হবে যাতে করে ভ্রূণের পক্ষে ক্ষতিকারক না হয়।


চ) পূর্বে থেকেই প্যাকেটজাত করা খাবারগুলোর সতেজতা অনিশ্চিত। তাই গর্ভাবস্থায় এ ধরনের খাবার যথা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত।


গর্ভবতী মায়ের আদর্শ খাবার রুটিন


গর্ভবতী মায়ের আদর্শ খাবার রুটিন

বর্তমানে অতিরিক্ত কম ওজন বা বাড়তি ওজনের কারণে গর্ভবতী মায়েদের বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর এ জন্য দরকার একটি যথাযথ গর্ভকালীন ডায়েট চার্ট । গর্ভধারণের সময়কে মূলত তিনটি ত্রৈমাসিকে ভাগ করা হয়েছে যেখানে ০ থেকে ১৩ সপ্তাহকে বলা হয় ১ম ত্রৈমাসিক, ১৪ থেকে ২৬ সপ্তাহ সময়কে বলা হয় ২য় ত্রৈমাসিক এবং সবশেষে ২৭ থেকে ৪০ সপ্তাহ সময়কে বলা হয় শেষ অর্থাৎ ৩য় ত্রৈমাসিক। প্রথম ত্রৈমাসিকে খাবারের পরিমাণে ক্যালরির পরিমাণ পরিবর্তন না হলেও পরবর্তী দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে প্রতিদিন অন্তত অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালরি ও ৪৫০ ক্যালরির করে বাড়তি খাবার গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া, গর্ভাবস্থায় মায়ের নানারকম শারীরিক সমস্যা থাকতে পারে। সাধারণ সমস্যাগুলোর মধ্যে কিছু হলো সকালে ঘুম থেকে উঠার পর বমি ভাব যাকে বলে মর্নিং সিকনেস, ক্ষুধামন্দা, অরুচি, কোষ্ঠকাঠিন্য।

একজন গর্ভবতী মাকে নিজের স্বাস্থ্য ও তার গর্ভস্থ ভ্রূণের সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হয় বলে গর্ভবতী মাদের একটি আদর্শ খাবার রুটিন অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের ৭-১১ কেজি ওজন বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরে যেন পর্যাপ্ত শক্তি থাকে ও হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও যেন ঠিক থাকে এজন্য প্রথম থেকেই একটা আদর্শ খাবার রুটিন মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।


সকালে কী খাবেন?


মর্নিং সিকনেসের জন্য সকালে ভারী খাবার না খাওয়াই ভালো। উঠেই সামান্য বিস্কুট বা মুড়ি এ জাতীয় শুকনা খাবার ও পানি খেয়ে কিছুক্ষন হাঁটাচলা করে নেওয়া ভালো। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানির সঙ্গে রাতে ভিজিয়ে রাখা চার থেকে পাঁচটি কাঠবাদাম খেতে হবে। বাদামে রয়েছে প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট, ফলিক অ্যাসিড,ভিটামিন ডি ও জিংক যা ভ্রূণের মস্তিষ্ক, শিশুর হৃদযন্ত্র এবং স্নায়ুবিক বিকাশে সাহায্য করে। এরপর ১-২টি রুটি সাথে ১ বাটি সবজি/ডাল/ তরকারি এবং একটি ডিম খাওয়া যেতে পারে। সকাল ১১ টার দিকে ১ গ্লাস দুধ বা ফলমূল খেতে পারেন। গম ও ভুট্টার তৈরী ছাতুতে প্রচুর ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন ও মিনারেলস আছে।  


দুপুরে কী খাবেন?


দেড় থেকে ২ কাপ ভাত বা ৩-৪ তা রুটি খাওয়া উচিত ভারী খাবার হিসেবে। এর সাথে সবজি/ ডাল/ তরকারি এবং অবশ্যই ৫০-৭০ গ্রাম মাছ/ মাংস খাওয়া উচিত। সাথে সালাদ খেতে পারেন। তবে একটি কাঁচা মরিচ খেতে ভুলবেননা। খাওয়ার পরে দই খেলে তা হজমে সাহায্য করবে। একজন গর্ভবতী মাকে দুপুরের খাবারে ভাতের পাশাপাশি খেতে হবে সামুদ্রিক মাছ বা লাল মাংস ও প্রচুর শাকসবজি। সামুদ্রিক মাছে রয়েছে আয়েডিন এবং প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড যেমন ওমেগা ৩ ও ৬ যা বাচ্চার ব্রেইনের উন্নতি সাধন করে। লাল মাংস অর্থাৎ গরুর মাংস ও দেশি মুরগির মাংসে রয়েছে প্রচুর আয়রন যা রক্তস্বল্পতার রোধে পাশাপাশি বাচ্চার সুষম গঠনে উন্নতি সাধন করে। তবে এ আয়রন শোষণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পাশাপাশি উচ্চ ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমন আমলকি,কমলা বা লেবু খেতে হবে

বিকেলে কী খাবেন?

বিকেলে খেতে পারেন স্যুপ, কাস্টার্ড বা বাড়িতে তৈরী যেকোনো নাস্তা। বাহিরের খাবার কিংবা চা-কফি খাওয়া মোটেই উচিত নয়। গর্ভকালীন ডায়েট চার্ট মেনে চলার সময় ওজনও নিয়ন্ত্রণে রাখা চাই। তাই তৈলাক্ত নাস্তার পরিবর্তে খেতে হবে ক্যালরিবহুল স্বাস্থ্যকর নাস্তা। এসময় খাবারের তালিকায় রাখা যায় চিকেন সুপ, দুধ ও বাদাম/পপকর্ন, মিক্স ফল বা ছোলা-মুড়ি, সালাদের যেকোনো একটি। দুধ গর্ভবতী মায়েদের জন্য একটি উত্তম খাবার কারণ দুধে রয়েছে ক্যালসিয়াম, জিংক, ভিটামিন এ, ডি ও ই পাশাপাশি কিছু প্রয়োজনীয় অন্যান্য মিনারেল যা শিশুর দাঁত, হাড়,নখ ও চুলের গঠনেও সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম শোষণেও ভিটামিন-ডি লাগে যা পাশাপাশি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধেও সাহায্য করে।


রাতে কী খাবেন?


রাতের খাবার দুপুরের খাবারের অনুরূপ। তবে শাক জাতীয় খাবার রাতে খেলে হজমে সমস্যা হতে পারে। তাই রাতে শাক না খাওয়াই উত্তম।


গর্ভকালীন সময়ে কোন ভিটামিন কতটুকু খেতে হবে ও এদের উৎস 


ক্যালসিয়াম

ক্যালসিয়াম শিশুর হাড়ের গঠনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। মা যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম না খান তবে শিশুর হাড় শক্ত হবে না। এমনকি ক্যালসিয়ামের অভাবে গর্ভাবস্থায় মায়ের কোমর ও পায়ের গোড়ালিতে ব্যাথা অনুভূত হতে পারে। দুগ্ধজাত খাদ্য যেমন দুধ, দই, পনির ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, মায়ের যদি হাই প্রেশার থাকে তবে দুধ না খেয়ে তাকে দই খেতে হবে। এছাড়াও প্রতিদিন ভাতের সাথে একটি কাঁচা মরিচ অনেকটা ক্যালসিয়ামের যোগান দিয়ে থাকে। মাছ ও মাছের কাটায় থাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম। মটরশুঁটি, বিভিন্ন ধরণের বাদাম, ছোলা ও শাকসবজি এবং ফলমূলেও থাকে ক্যালসিয়াম। এরপরও ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভবতী মাকে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে দেওয়া হয়।


আয়রন

আয়রনের ঘাটতি হলে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়। অনেক শিশুর জন্মের পর থেকেই হিমোগ্লোবিনের অভাব বা রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় আয়রনের ঘাটতির কারণে। তাই গর্ভাবস্থায় মাকে প্রচুর আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। কচু শাক, লাল শাক, পালং শাক, কাঁচা কলা, ডালিম, বিটস, বাদাম, ছোলা, খেজুর, কলিজা, শিং মাছ, মাগুর মাছ ইত্যাদিতে থাকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন।


ফলিক এসিড

ফলিক এসিড বা ফোলেট এক ধরণের ভিটামিন বি কমপ্লেক্স জাতীয় উপাদান। গর্ভের সন্তানের হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক সুস্থ রাখতে ও অঙ্গহানি রোধ করতে ফলিক অ্যাসিড একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। বিভিন্ন ফলমূল যেমন আম, জাম, লিচু, কমলা, আঙ্গুর, স্ট্রবেরি ইত্যাদিতে থাকে ফলিক এসিড। এছাড়া সবুজ পাতা সমৃদ্ধ খাবার যেমন- পুঁইশাক, পাটশাক, মূলাশাক, সরিষা শাক, পেঁপে, লেবু, ব্রকলি, মটরশুঁটি, শিম, বরবটি, বাঁধাকপি, গাজর ইত্যাদি ও বিভিন্ন ধরনের ডাল যেমন- মসুর, মুগ, মাষকালাই, বুটের ডাল ইত্যাদিতে ফলিক এসিড প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। এছাড়াও সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখীর বীজ, লাল চাল, লাল আটা ইত্যাদি ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার। তবে মায়ের শরীরে পর্যাপ্ত ফলিক এসিডের পরিমাণ নিশ্চিত করতে গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই ডাক্তাররা ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।


জিংক

গর্ভাবস্থায় জিঙ্কের পরিমাণ কম হলে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া দেহের বৃদ্ধি রোধ বা বামনত্ব হতে পারে। এছাড়াও জিংকের অভাবে পরবর্তীতে শিশুর ডায়রিয়া বা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও কনজাংকটিভার প্রদাহ, পায়ে বা জিহ্বায় ক্ষত, মুখের চারপাশে ক্ষত, আচরণগত অস্বাভাবিকতা, অমনোযোগিতা, বিষন্নতা, সিজোফ্রেনিয়া, ক্ষুধা মন্দা দেখা দেয়। ভেড়া ও গরুর মাংস,ফুলকপি,সবুজ শিম, টমেটো ইত্যাদিতে জিংক রয়েছে। সামুদ্রিক মাছ, গরু-খাসির কলিজা, আটা-ময়দার রুটি, দুগ্ধজাত খাদ্য, শিমজাতীয় উদ্ভিদ, মসুর ডাল, চীনাবাদাম, মাশরুম, সয়াবিন ও ঝিনুকে জিংক পাওয়া যায়।


আয়োডিন

আয়োডিন শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ও শারীরবৃত্তীয় কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। এর অভাবে শিশুর প্রতিবন্ধী হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় আয়োডিন যুক্ত লবণ খাওয়া জরুরি। এছাড়াও সামুদ্রিক মাছ, দুধ, দই, পনির, ডিম্, কলা ও কলার মোচা ইত্যাদিতে থাকে প্রচুর আয়োডিন।


ভিটামিন এ

ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুর দৃষ্টিশক্তি হীনতা হতে পারে। ভিটামিন এ চোখের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়া ভিটামিন এ দেহের বৃদ্ধি ও চর্ম, দাঁত ও অস্থির গঠন এবং নানা রকম সংক্রামক রোগ হতে শরীরকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয়। সকল প্রকার রঙিন ফলমূল ও শাকসবজি তে আছে ভিটামিন এ। এছাড়া মলা ও ঢেলা মাছ, ডিমের কুসুমেও এটি বিদ্যমান।


ভিটামিন ডি

ভিটামিন ডি দেহের অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়ামকে শোষণ করে। ভিটামিন ডি র অভাবে শিশুদের হাড় ঠিকমতো বৃদ্ধি পায় না এবং হাড় বাঁকা হয়ে যায়। দুধ, দই, পনির, ডিম্, সামুদ্রিক মাছ, গরুর কলিজা, মাছের তেল, মাশরুম ইত্যাদিতে আছে ভিটামিন ডি।


তথ্যসূত্রঃ দৈনিক পত্রিকার পুষ্টিবিষয়ক বিভিন্ন আর্টিক্যাল ও বিভিন্ন সংস্থার গাইডলাইন। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url