মুসলিম পোশাক সংস্কৃতি ও তার অপব্যবহার

১. আরসিএল কোম্পানি বহু টাকা পয়সার ঘাবলাসহ নষ্ট হয়ে গেলো। মানুষের কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেলো। এলাকায় আরসিএলের দায়িত্বশীলেরা পালিয়ে গেলেন। কেউ বিদেশে চলে গেলেন, কেউ বা গা' ঢাকা দিয়ে আছেন বহুদিন যাবত। মানুষের আক্রোশের ভয়। তাদের চাপে পড়ার ভয়।  কিন্তু আরসিএলের একজন দায়িত্বশীলকে আমি চিনি। যিনি এমন ঘোটালা ঘটবার পর সৌদিতে চলে গিয়েছিলেন। হজ্জ্ব করেছেন। এবং লম্বা জুব্বা ও টুপি লাগিয়ে দেশে ফিরে আসলেন এবং এলাকাতেই আসলেন সরাসরি।  টুপি-পাঞ্জাবি পড়ে নিয়মিত চলাফেরা করেন আজকাল। আর সবকিছু তার জন্য স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। এমনকি লোকজন তার প্রতি সেই আক্রোশ হারিয়ে এখন সম্মান দিচ্ছে খুব। তিনিও মোটামুটি ভালো প্রতাপেই দিন যাপন করছেন। কারো টু' শব্দটিও নেই।


২. এক বড় ভাই ছিলেন পাশের এলাকার। ভালোই পরিচিত ছিলেন। একবার জেল খেটেছিলেন মাদক ও নারী সংক্রান্ত কোনো কেসে। প্রভাবশালী ছিলেন বলে ব্যাপারটা ঐ এলাকার লোকজনের কাছে অপেন-সিক্রেট ব্যাপার ছিলো। তিনি পরবর্তীতে সে এলাকাতেই একটা সুন্দর ইমেজ ধারণ করে ফেলেছেন। কিভাবে জানেন? জেল থেকে আসার পর তিনি তাবলীগ জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন। মাঝে মাঝে চিল্লা দিতেন। লম্বা জুব্বা ও টুপি ধারণ করেছেন দেহে। মানুষ তাকে দেখলে এখন সালাম দিচ্ছেন। 

৩. আরেকজন মানুষ ছিলেন আমার পছন্দের। তিনি কোরআনের হাফেজ ছিলেন। এলাকার মসজিদে মাঝে মাঝে নামাজ পড়াতেন ও ঈদগাহে বক্তব্য করতেন। এবং কুষ্টিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে ভালো একটা সাবজেক্টে পড়াশোনা শেষ করলেন। এখন একটা বেসরকারি কোম্পানিতে তিনি জব করেন। কোম্পানিতে চাকুরী করার সুবাদে তাকে কোর্ট-প্যান্ট পড়তে হয় এবং তিনি স্বাচ্ছন্দ্যেই তা পরিধান করেন। কিন্তু এ বছর তার এলাকায় তাকে নামাজ পড়ানো এবং ঈদগাহে বক্তব্য দিতে না করা হয়েছে এলাকার মুরুব্বিদের মত অনুযায়ী। কারণ কি? কারণ তিনি আজকাল কোর্ট-প্যান্ট পরছেন।

৪. এলাকার একজন মেয়ে ছিলো আমাদের সমবয়সী। তাকে ব্যাচমেট হওয়ায় ভালোই চিনতাম আমরা। সম্ভবত খুব কম বাজে ব্যাপারই আছে যে তাতে সে জড়িত থাকতো নাহ। দু'জন বড়ভাইকে কিভাবে যেন ফাঁসিয়ে বড় অংকের অর্থ সে বাগিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু তাকে এলাকার খুব কম মানুষই খারাপ বলেন। সেদিন তার বিবাহের একটা সম্মন্ধের ব্যাপারে কথা হচ্ছিল। চারজন মুরুব্বির মাঝখানে বসেছিলাম। সবার রিভিউ ছিলো মেয়ে ভালো। যথেষ্ট সুশীল।  এই ভালো হবার কি কারণ তারা দেখিয়েছিলেন, জানেন? কারণ ছিলো,  মেয়ে বোরকা পরিধান করে ও পর্দানশীন , তাই সে সুশীল ও ভালো মেয়ে।

৫. আমার আরেকজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। যিনি যথেষ্ট সুন্দরী মানুষ। এবং আমি তারমাঝে খুব কম খারাবিই দেখেছি যার কারণে তাকে খারাপ বলা যায়। তারসাথে আমার দীর্ঘদিনের চলাফেরা ছিলো। কিন্তু এলাকার কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে তিনি যুতসই মেয়ে নন। কেনো জানেন? কারণ তিনি সেজেগুজে চলাফেরা করেন, গাড়ো রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করেন এবং হিজাব করেন কিন্তু নিকাব করেন না। তাই তার ব্যাপারে কেউ উল্টাপাল্টা কিছু বললেও লোকজন সহজেই বিশ্বাস করে ফেলেন। 

আসলে ঘটনাগুলো বলার মূল কারণ ছিলো আমাদের বাংলাদেশের পোশাক কেন্দ্রিক ধার্মিকতার ব্যাপারে কিছু বলা। এখানে পোশাকের ধর্মটা খুব প্রকট। এবং এই মুলুকে টুপি-পাঞ্জাবীকে সুন্নতি পোশাক মনে করার মত এক হাস্যকর ধারণা প্রচলিত আছে। এখানে একটা মানুষকে মূল্যায়ণ করা হয় কেবল তার পোশাক এবং বাহ্যিক লুক দিয়ে। সে কতটুকু ঈমানদার তার পরিমাপ ও হয় কেবল পাঞ্জাবির সাইজ দিয়ে। 

সেদিন বিশ্ব খ্যাত ইসলামিক স্কলার তুরষ্কের প্রফেসর মেহমেদ গরমেজের একটা অনুবাদ মিম্বার গ্রুপে পোস্ট করা হলে সেখানের কমেন্ট সেকশন দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। লোকজন কমেন্ট করছে- ইসলামিক স্কলার কিন্তু দাড়ি নাই, হা হা, যার নিজের শরীরে ইসলাম নাই, সে কিসের ইসলাম শিখাবে ব্লা ব্লা। অক্সফোর্ডের ইসলামিক স্কলার তারিক রামাদানের ব্যাপারেও এদেশীয়দের সেম অভিমত, বাহ্যিক লুক দেখে বিচার করা হয়। সাইয়েদ কুতুব শহীদ ও ইকবালদের সৃষ্টি অন্যান্য চিন্তা ও দর্শনকে মোকাবিলা করার জন্য মোল্লাদের অন্যতম হাতিয়ার এবং এদের বিকল্প নেই বলে তাদের ব্যাপারে এরা খানিক চুপ থাকেন।

আবার ইসলামিক নারী স্কলাররা বহির্বিশ্বে নিয়মিত পুরুষ শ্রোতাদের সামনে  লেকচার দিচ্ছেন চেহারা খোলা রেখেই। তাদের সামনে অন্য পুরুষ ইসলামিক স্কলাররাও উপস্থিত থেকে লেকচার শুনে থাকেন। এদেশে এমনটা হলে ঐ নারীকে যথাসম্ভব নেগেটিভ ভাবে উপস্থাপন করা হতো। হিজবুত তাহরীরের  একটা মেয়েকে দেখি মাঝে মাঝে ইসলামিক টপিকগুলো নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা টেনে থাকেন। তার আলোচনার ব্যাপারে কথা বলার চাইতে কমেন্ট সেকশনে তার ব্যাপারে নেগেটিভ আলোচনা বেশি করা হয়। তাকে বেশ্যা পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে কথিত ধার্মিকদের মুখ দিয়েই। 

সাধারণ নারীদের চেহারা খোলা রাখা নিয়েও কোরআন কোন বাধ্যকতা দেয়না। কেবল বুকে চাদর রাখা ছাড়া স্পেশাল কোনো শর্ত নেই কোরআনে। এই শালীনতা ঠিক থাকলে একটা নারীর থ্রিপিস, কোর্ট স্যুটেও কোন আপত্তি নেই ইসলামের। বহির্বিশ্বের নারী ইসলামিক স্কলাররা কোর্ট-স্যুটও পরিধান করে থাকেন। তবে বেশিরভাগ স্কলার নারীসুলভ পোশাক এবং মুখ খোলা রাখা হিজাব পরিধান করেন। খুব কম স্কলার আছেন যে বোরকা পরিধান করে থাকেন। আর এই বোরকা পরিধান কোরআনের শর্তও না।  কিন্তু ঠিক সে রকম চলাফেরা করলেও নিকাব না বাঁধার কারণে একটা মানুষের ঈমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় আমাদের দেশে। তাকে খারাপ বানিয়ে দেয়া হয় বোরকা পরিধান করা নারীটির তুলনায়।

ব্যাপারগুলো কেন হয় তা দেখতে গিয়ে আমি পেলাম - লিবাসুত তাকওয়া বা "তাকওয়ার পোশাক" কোরআনের এ ধারণার ব্যাখ্যা। যার ব্যাখ্যায় কতিপয় ধর্মীয় মোল্লারা বলেন- তাকওয়ার পোশাক এমন একটি পোশাক 'যে পোশাক পরিধান করলে আল্লাহভীতি বৃদ্ধি পায়। কি আজব ব্যাখ্যা! 

আবার পড়তে পড়তে মাদ্রাসার আলিম শ্রেণীর একটা গাইড বইয়ের একটাস্থানে সাহাবায়ে কেরামের ব্যাখ্যাও পেলাম। তাদের আলাপ আমার যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। সুরা আরাফের ২৬নং আয়াতে আল্লাহ এক ধরণের বিশেষ পোশাক বা আচ্ছাদনের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। এই খোদাভীতির পোশাক বা লিবাসুত তাক্বওয়ার এর ব্যাখ্যায় সাহাবাদের মত এই যে- 
১.ইবনে আব্বাস বলেন; এর দ্বারা 'ভালো কাজ উদ্দেশ্য।
২.ওসমান বলেন; এর দ্বারা 'সুন্দর আচরণ' উদ্দেশ্য।
৩.উরওয়া ইবনে যোবায়ের রা. বলেন; এর দ্বারা 'আল্লাহ ভীতি' উদ্দেশ্য।

কিন্তু এই তাকওয়ার পোশাকের ধারণাটিকে  সুন্দর আচরণ,  ভালো কাজ,  ও স্রষ্টাভীতির মত এত উচ্চ ও ক্রিটিকাল ধারণা থেকে সরিয়ে যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ও সালাফি মোল্লাদের কথামতো পোশাকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে তখনই সমাজে উপরের ১-৫ নম্বর ঘটনাগুলো ঘটছে। মানুষ অসংখ্য মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করেও এসব পোশাক পরার কারণে সম্মানিত হয়ে যাচ্ছে,  নারী ও মাদক কেন্দ্রিক বদনাম থেকে বাঁচতে এসব পোশাকের দারস্থ হচ্ছে, ব্লাকমেইলার  খারাপ মেয়েটিও বোরকা নামক পোশাকের আশ্রয় নিয়ে ভালো ও সুশীল খেতাব পেয়ে যাচ্ছে,  ভালো মানুষটিও কেবল নিকাব না করায় বিভিন্ন অপবাদের স্বীকার হচ্ছে!  

অথচ পাঞ্জাবী ছিলো আবু জেহেল ও আবু লাহাবদের পোশাক। তাদের পোশাকের সুন্নাত তথা রীতি ছিলো এটি ।  নবী মুহাম্মদ সেই লাহাব পরিবারের সদস্য হবার সুবাদে এই পোশাক পেয়েছেন।  আইয়ামে জাহেলিয়ার সেই জাহেলদের পোশাকও এটি। নবী তাদের অধিবাসী হবার সুবাদেই এটি পেয়েছেন। এটা খোদা তাকে ওহী করে পাঠান নি। যেমন খেজুর খাওয়া আবু জেহেলের সুন্নাত, আবু লাহাব,  উতবা,  শায়বাদের সুন্নাত। মুহাম্মদ এটি আরব হবার সুবাদে পেয়েছেন ও খেয়েছেন। বাংলাদেশে থাকলে মোটা চালের ভাত আর বিকেলে টঙ্গের দুধ চা পাইতেন এবং খাইতেন। এগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার। এগুলোর সাথে সুন্নত সম্পৃক্ত করাটা বোকামি।

পোশাকের ধার্মিকতাকে ঠেকানো উচিত। পাঞ্জাবি, টুপি ও বোরকাকে ধর্মীয় পোশাক ভাবা বন্ধ করা উচিত। মানুষকে পোশাক ও বাহ্যিকতা দিয়ে মূল্যায়ণ করার মানসিকতা বদলানো উচিত। ইসলাম বিশ্বজনীন ধর্ম। এর কোনো নির্দিষ্ট পোশাক নেই। আমার এক ছোটভাইর সাথে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে সে একটি প্রশ্ন করলো- কিন্তু ভাই, উপমহাদেশের অধিকাংশ আল্লাহ ওয়ালা মানুষ তো এই পোশাকই পরিধান করেন। তাকে বলেছি- কেউ পড়েন ঠিক, তবে অধিকাংশ আল্লাহ ওয়ালা পড়েন এমনটা নয়, ব্যাপারটা হলো যারা পড়েন তাদেরকেই তুমি আল্লাহ ওয়ালা মনে করো বেশি। আল্লামা ইকবালেরা কি কম আল্লাহ ওয়ালা ছিলেন বলো? তাতো নয়। বরং এটা আরব ভুখন্ডের পোশাক। তারা গরম ঠেকাতে এগুলো পরে থাকে।  মুহাম্মদও গরমের কারণেই তা পরিধান করতেন। আলাক্সা পর্বতে নবী মুহাম্মদকেও যদি পাঠানো হয়, সে এ পোশাক পায়ের নীচে ফেলে জ্যাকেট-স্যুট, কোর্ট  ও ট্রাই পড়ে বসে থাকবে। সাদা জোব্বা পড়লে সেখানে মারা পড়বে। বরফের দেশে কাউকে সাদা পড়তে দেখো, তেমনটা?  সে কিছু বললোনা। গরমের দেশে যেমন কালো বেরকা এক ধরনের অত্যাচার, ঠিক তেমন বরফের দেশেও সাদা জুব্বা একধরণের অত্যাচার। ইসলাম অত্যাচার করতে আসেনি। ইসলাম পোশাকবিহীন মানুষেরও ধর্ম। কাপড়ের অভাবে উলঙ্গরাও কিভাবে নামাজ পড়বে তার বিধানও ইসলামে আছে। বাঙালি পোশাক বা চীনা পোশাক পরেও ভালো মুসলিম হওয়া যায়, ওয়েস্টার্ন পরিহিত বহু আল্লাহওয়ালাও বর্তমান আছেন। পরিশেষে   তাকে আল্লামা ডক্টর মুহাম্মদ ইকবালের একটি লাইন বলে শেষ করলাম- Leave the movement of body dance for Europe, In the dance of Soul, there is real smell of ALLAH. 

লেখকঃ মাহিন ফারাজি/ইসলামিক স্টাডিজ/ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url