সামাজিক কার্যক্রমঃ ধারণা, উপাদান, প্রক্রিয়া ও গুরুত্ব
সামাজিক কার্যক্রমের ধারণা (Concept of Social Action)
সামাজিক কার্যক্রম সমাজকর্মের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি সহায়ক পদ্ধতি। সামাজিক কার্যক্রম পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত উপায়ে সমাজ পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া। সমাজে যেসব প্রচলিত অপসংস্কৃতি, কুপ্রথা এবং অব্যবস্থা রয়েছে তা দূর করে একটি কাঙ্খিত বা বাঞ্ছিত সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। শুধু অব্যবস্থা দূর করাই নয় কীভাবে সমাজকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করা যায় তার জন্য সামাজিক কার্যক্রম বিশেষভাবে পরিচালিত হয়।
এ অর্থে সমাজ উন্নয়ন প্রচেষ্টায় এবং সমাজব্যবস্থাকে গতিশীল করার জন্য সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সাধারণভাবে সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত অনভিপ্রেত অবস্থাকে সচেতন ও সুপরিকল্পিতভাবে পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া হলো সামাজিক কার্যক্রম।
সমাজকর্ম অভিধানের ভাষায়, সামাজিক কার্যক্রম হলো সামাজিক সমস্যার সমাধান, অন্যায় বা অবিচার সংশোধন, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
Arthur Dunhum এর মতে, “সামাজে বাঞ্ছিত পরিবর্তন আনয়ন অথবা অবাঞ্ছিত পরিবর্তনকে বাধা দেয়ার জন্য গৃহীত সম্মিলিত প্রচেষ্টাই হলো সামাজিক কার্যক্রম।” উপর্যুক্ত সংজ্ঞাসমূহ বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সামাজিক কার্যক্রম হলো একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্খিত অবস্থার সুপরিকল্পিত পরিবর্তন সাধন করে জনগণের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামাজিক উন্নয়ন সাধনে প্রচেষ্টা চালানো হয়।
সমাজকর্মের অন্যতম সহায়ক পদ্ধতি হিসেবে সামাজিক কার্যক্রম সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত উপায়ে সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে। সমাজে প্রচলিত যেসব কুসংস্কার, কুপ্রথা এবং অবাঞ্ছিত অবস্থা রয়েছে তা দূর করে একটি কাঙ্খিত ও বাঞ্ছিত সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে পরিচালিত যৌথ প্রচেষ্টাই হলো সামাজিক কার্যক্রম। মূলত সামাজিক কার্যক্রম হলো সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত এমন একটি দলীয় প্রচেষ্টা যার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন, সমাজের প্রয়োজন পূরণ, সামাজিক আইন ও নীতি বাস্তবায়ন, সমাজসংস্কার এবং বাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধিত হয়।
সামাজিক কার্যক্রমের উপাদান (Components of Social Action)
সামাজিক কার্যক্রম একটি পরিকল্পিত, সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত প্রক্রিয়া, যা কোনো সামাজিক বিষয়ের পরিবর্তন আনয়নে জনগণের সমর্থন অর্জনের মাধ্যমে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছায়। সামাজিক কার্যক্রমে লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়া বহুবিধ উপাদানের সমষ্টি। নাখান ই. কোহেনের মতে, সামাজিক কার্যক্রমের উপাদান পাঁচটি। যথা: ১) গবেষণা, ২) পরিকল্পনা, ৩) জনসমর্থন আদায়, ৪) ব্যাখ্যাকরণ ও ৫) বাস্তবায়ন। আবার স্যোশ্যাল ওয়ার্ক ইয়ার বুক : ১৯৫১ অনুযায়ী সামাজিক কার্যক্রমের উপাদানগুলো হলো: ১) গবেষণা, ২) সমস্যা সমাধান পরিকল্পনা, ৩) জনসমর্থন আদায়, ৪) সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপনা এবং ৫) কার্যকরকরণ। সার্বিকভাবে সামাজিক কার্যক্রমের উপাদানগুলো নিচে আলোচনা করা হলো :
১) সমস্যা : সামাজিক কার্যক্রমের অন্যতম উপাদান হলো সমস্যা। যে বিষয়কে কেন্দ্র করে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাকে সামাজিক কার্যক্রমের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন: যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং ইত্যাদি।
২) সমাজকর্মী বা সামাজিক আন্দোলন কর্মী : সামাজিক কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সমাজকর্মী বা সামাজিক আন্দোলন কর্মী। সামাজিক কার্যক্রমে সমাজকর্মীর ভূমিকা নেতৃত্বদানকারী এবং সচেতনতা সৃষ্টিকারী। সমাজকর্মীকে এজন্য সামাজিক আন্দোলন কর্মী বলা হয়। সমাজকর্মী ব্যতীত সামাজিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
৩) সামাজিক গবেষণা : গবেষণা সামাজিক কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যখন কোনো বিষয় বা সমস্যাকে কেন্দ্র করে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তখন উক্ত বিষয় এবং সংশ্লিষ্ট আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে তথ্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। এক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য হতে সমস্যা বা নির্দিষ্ট বিষয়ের গভীরতা, ব্যাপকতা ও গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় এবং সে অনুযায়ী লক্ষ্য অর্জনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়।
৪) সমাধান পরিকল্পনা : সামাজিক কার্যক্রমের লক্ষ্য হলো সমাজ হতে অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্খিত কুপ্রথা, আচার-আচরণ, অভ্যাস ও মূল্যবোধের পরিবর্তন সাধন। এক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলী বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বিষয় বা সমস্যা সম্পর্কে যথাযথভাবে জেনে সমাধান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কারণ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ব্যতীত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না।
৫) জনসমর্থন আদায় : সামাজিক কার্যক্রম হলো একটি দলীয় প্রচেষ্টা। জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা পরিচালিত কর্ম প্রক্রিয়া হলো সামাজিক কার্যক্রম। এক্ষেত্রে সমাজে বাঞ্ছিত পরিবর্তন আনতে কর্মসূচির প্রতি জনগণের সমর্থন আদায় অপরিহার্য উপাদান। সমস্যা ও সমস্যার সমাধান ব্যবস্থার খুটিনাটি সকল দিক সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে করে তাদের সমর্থন আদায় এবং কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৬) প্রস্তাব উপস্থাপন : গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমস্যা নির্দিষ্টকরণ, সমাধান পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সমস্যা সংশ্লিষ্ট সমাধান কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থন আদায়ের সাথে সাথে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাব উপস্থাপন করা সামাজিক কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রস্তাবনা মূলত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের উপস্থাপনাকেই বুঝায়। সামাজিক কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনাকারীগণ কর্তৃপক্ষের নিকট সুর্নিদিষ্ট প্রস্তাবনা উপস্থাপণ করে থাকেন।
৭) কার্যকরকরণ : সামাজিক কার্যক্রমের সর্বশেষ উপাদান হলো কার্যকরকরণ। সামাজিক কোনো বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন, জনসমর্থন আদায় এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপণার পরও যদি সেগুলো কার্যকর করা না হয় তাহলে কার্যক্রমের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। এজন্য অবশ্যই এগুলো যথাযথভাবে কার্যকর বা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হয়। সামাজিক কার্যক্রম কার্যকরকরণের দুটি উপায় রয়েছে। যথা: সামাজিক আইন ও সামাজিক নীতি প্রণয়ন।
সামাজিক কার্যক্রম একটি সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল কর্মপ্রক্রিয়া যা সমাজ হতে বিভিন্ন অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্খিত অবস্থা দূর করে সমাজে বাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধন ও কাঙ্খিত উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে সামাজিক কার্যক্রমের কতগুলোা সুনির্দিষ্ট উপাদান পরস্পর অবিচ্ছিন্নভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। সামাজিক কার্যক্রমের এই উপাদানগুলো হলো: ১) সুনির্দিষ্ট বিষয় বা সমস্যা, ২) সমাজকর্মী বা সামাজিক আন্দোলন কর্মী, ৩) সামাজিক গবেষণা, ৪) সমাধান পরিকল্পনা, ৫) জনসমর্থন আদায়, ৬) যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা ও ৭) কার্যকরকরণ।
সামাজিক কার্যক্রম প্রক্রিয়া (Process of Social Action)
সামাজিক কার্যক্রম একটি সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়া। এ প্রাক্রিয়াটি ধারাবাহিক ও সুপরিকল্পিতভাবে সামাজিক অনভিপ্রেত অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সামাজিক উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে দলীয়ভাবে প্রচেষ্টা চালায়। এক্ষেত্রে সামাজিক কার্যক্রম সুর্নির্দিষ্ট ও পর্যায়ক্রমিক কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়। আরমান্ডো টি. মরেলস ও ব্রাডফোর্ড ডব্লিউ. শেফর সামাজিক কার্যক্রমের ৯টি প্রক্রিয়া উল্লেখ করেছেন। যথাঃ ১) গবেষণা, ২) শিক্ষা, ৩) সমন্বয় সাধন, ৪) সংগঠন, ৫) মধ্যস্থতা, ৬) সমঝোতা, ৭) মৃদুশক্তি প্রয়োগ, ৮) সামাজিক আইন ভঙ্গ এবং ৯. যৌথ কার্যক্রম। ভারতের সর্বদায়া আন্দোলনের কর্মীরা সামাজিক কার্যক্রমের যে সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকেন তা হলো: ১) প্রচার, ২) পরিচিতি, ৩) অধ্যয়ন বা অনুধ্যন, ৪) সভা বা সমিতি, ৫) সেবা, ৬) প্রতিকার, ৭) গঠনমূলক কাজ বা সমষ্টি সেবা এবং ৮) পরিবর্তিত পরিস্থিতি উপযোগী পরিবেশ গঠন। সার্বিকভাবে সামাজিক কার্যক্রমের প্রক্রিয়াসমূহ নিচে আলোচান করা হলো :
১) অনুভূত প্রয়োজন বা সমস্যা চিহ্নিতকরণ : সামাজিক কার্যক্রম সফল করতে হলে প্রথমেই নির্দিষ্ট বিষয় বা সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করতে হয়। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বহুমুখী ও পরস্পর নির্ভরশীল সমস্যা বিরাজমান। এ ধরনের সমস্যার মধ্যে থেকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বা প্রাধান্য বিস্তারকারী সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান ব্যবস্থা গ্রহণ করে সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সামাজিক কার্যক্রমের অন্যতম লক্ষ্য। সমস্যা চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে সমস্যা সম্পর্কিত জনগণের মতামত, যথাযথ তথ্য সংগ্রহ, শিক্ষিত ও বিশেষজ্ঞ শ্রেণির মতামত গ্রহণ, সরকারি-বেসরকারি রেকর্ড পর্যালোচনা এবং গণমাধ্যমে সমস্যার তীব্রতা সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রভৃতি বিবেচনায় আনতে হয়।
২) গবেষণা : সামাজিক কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা চিহ্নিতকরণের পর সমস্যা সম্পর্কিত যথাযথ ধারণা লাভের জন্য তথ্য সংগ্রহ প্রয়োজন। গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমে সমস্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে সমস্যার প্রকৃতি, ধরন, কারণ এবং প্রভাব নির্ণয়ের মাধমে সমাধান পরিকল্পনার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।
৩) সচেতনতা সৃষ্টি : সমস্যার প্রকৃতি, ধরন, কারণ এবং প্রভাব নির্ণয়ের পর সমস্যার ব্যাপকতা ও প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে সচেতনতা সৃষ্টি সামাজিক কার্যক্রমের অন্যতম প্রক্রিয়া। জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে সভা-সমাবেশ, সেমিনার, চিত্রপ্রদর্শনী, প্রচারপত্র বিলি, বিভিন্ন প্রিণ্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
৪) সমাধান পরিকল্পনা : সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাজ হতে দূর করতে যথাযত সমাধান ব্যবস্থা গ্রহণ সামাজিক কার্যক্রমের অন্যতম প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, দল, সমষ্টি ও প্রতিষ্ঠানের মনোভাব ও চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সমাধান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
৫) সংশ্লিষ্ট দল ও গোষ্ঠীর সমর্থন আদায় : সমস্যার ব্যাপকতা, প্রভাব প্রভৃতি সম্পর্কে যথাযথ তথ্য সরবরাহ করে সমস্যা মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ ও তার যথাযথ কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর সমর্থন আদায় এবং সমস্যা মোকাবিলায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সামাজিক কার্যক্রমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ পদক্ষেপের ফলে সামাজিক কার্যক্রমের লক্ষ্য অর্জন ত্বরান্বিত হয়। এছাড়া দল ও সমষ্টিতে অবস্থানরত বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব তাদের মূল্যবান মতামত উপস্থাপন করে কার্যক্রমের উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করে থাকেন।
৬) কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাব উপস্থাপন : কোনো বিষয় বা সমস্যা সম্পর্কে জনমত আদায়ের পর জনগণের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জনসমর্থিত বিষয়াবলী যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করা হয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষ বলতে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, নীতি নির্ধারক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে বুঝানো হয়ে থাকে। সামাজিক কার্যক্রম তখনই সফল হবে যখন যথাযথ কর্তৃপক্ষ উপস্থাপিত বিষয়টি যথার্থ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
৭) কার্যক্রম পরিচালনা : কর্তৃপক্ষের নিকট জনসমর্থিত প্রস্তাবনা উপস্থাপনার পর তা অনুমোদনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ পর্যায়ে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমবেত প্রচেষ্টা চালানো হয় যাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। সমবেত প্রচেষ্টার ফলে অনেক সময় গণআন্দোলন বা গণবিপ্লব সংঘটিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন সংগঠন, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, যুবসমাজ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের যথাযথ ইতিবাচক ভূমিকা এ পর্যায়ের কার্যক্রম পরিচালনায় যথার্থ সহায়তা করে থাকে।
৮) বাস্তবায়ন : যথাযথ কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রস্তাবনা গৃহীত ও অনুমোদিত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিষয়টি বাস্তবায়নে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করা হয়।
৯) মূল্যায়ন : সামাজিক কার্যক্রম প্রক্রিয়ার সর্বশেষ পর্যায় হলো মূল্যায়ন। এ পর্যায়ে কার্যক্রমের সার্বিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ কতটা কার্যকর হলো তা মূল্যায়ন করা হয়। কার্যক্রমের এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সমস্যা চিহ্নিতকরণ পর্যায় থেকে শুরু হয়ে বাস্তবায়ন পর্যায় পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলমান।
সামাজিক কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত দলীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাজে বিরাজমান ক্ষতিকর ও অনভিপ্রেত প্রথা দূরীকরণ, বাঞ্ছিত পরিবর্তন আনয়ন, প্রশাসনকে প্রভাবিত করে আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন ও জনসমষ্টির সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য অর্জনে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কতগুলোা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। সামাজিক কার্যক্রমে অনুসৃত প্রক্রিয়াসমূহ হলো: ১) সমস্যা চিহ্নিতকরণ, ২) সামাজিক গবেষণা, ৩) জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, ৪) সমাধান পরিকল্পনা, ৫) জনসমর্থন আদায়, ৬) নির্দিষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপন, ৭) কার্যক্রম পরিচালনা, ৮) বাস্তবায়ন ও ৯) মূল্যায়ন।
সামাজিক কার্যক্রমের গুরুত্ব (Importance of Social Action)
সামাজিক কার্যক্রম এমন একটি সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা যার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন কুপ্রথা, কুসংস্কার, অনাচার, অসমতা, বৈষম্য, আর্থ-মনো-সামাজিক বঞ্চনাসহ বিভিন্ন অবাঞ্ছিত অবস্থা যা জনসমষ্টির উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে; তার অবসান ঘটিয়ে স্বাভাবিক সামাজিক উন্নয়নের ধারা অব্যহত রাখতে জনকল্যাণমুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ব্যক্তি, দল, সমষ্টির সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতিসমূহের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে সামাজিক কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক কার্যক্রমের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ : বাংলাদেশে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, জনসংখ্যাস্ফীতি, স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, সুচিকিৎসার অভাব, দূর্নীতি, নিরক্ষরতা, ভিক্ষাবৃত্তি, অপরাধ ও সন্ত্রাস, কিশোর অপরাধ, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, ইভ টিজিং, জঙ্গিবাদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামীসহ নানা সমস্যা বিরাজমান যা সামাজিক উন্নয়ন ও কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এ সকল সমস্যাবলীর বিরুদ্ধে জনমত গঠন, সামাজিক আন্দোলন পরিচালনা, প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সামাজিক কার্যক্রমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
২. কুপ্রথা ও কুসংস্কার দূরীকরণ : সুশিক্ষার অভাবে নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মাঝে আজও পশ্চাৎমুখী মনোভাব, কুসংস্কার ও অদৃষ্টবাদী চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়। এ সকল ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার, কুপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠন, প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সকল কুপ্রথা ও কুসংস্কার দূর করে সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে সামাজিক কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৩. অধিকার প্রতিষ্ঠা : সমাজকর্মের সহায়ক পদ্ধতি হিসেবে সামাজিক কার্যক্রম সমাজে বসবাসরত মানুষকে, বিশেষ করে বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন করে আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। যথোপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, সেমিনার, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে নাটক ও বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমে জনগণকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে সামাজিক কার্যক্রম। ফলে জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এবং কাঙ্খিত সামাজিক পরিবর্তন আনয়নের লক্ষ্যে জনগণ সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে ।
৪. আইন ও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন : সামাজিক সমস্যার প্রেক্ষাপটেই সামাজিক কার্যক্রমের উদ্ভব হয়েছে। সামাজিক সমস্যা সমাধানে অনেক সময় প্রয়োজনীয় নীতি ও আইন প্রণয়ন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। চিহ্নিত বিষয় বা সমস্যা সম্পর্কে জনমত গঠন করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে। প্রণীত আইন ও নীতির যথাযথ বাস্তবায়নও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রণীত আইন ও নীতি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি জনকল্যাণের লক্ষ্যে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক নীতি ও আইন বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সামাজিক কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৫. নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ : দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, অপহরণ, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও নিপীড়ন, তাদের অনৈতিক বিভিন্ন কাজে ব্যবহারসহ নানা কারণে তারা তাদের স্বাভাবিক সামাজিক ভূমিকা পালন করতে পারেনা। এক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টি, জনমত গঠন ও নারী অধিকার আদায়ে নারীদের মধ্যে সচেতনতা ও সক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ ও তাদের সার্বিক উন্নয়ন সাধনে সামাজিক কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৬. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন : আধুনিক, জীবনমুখী ও কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রচলিত পশ্চাদমুখী ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে জনগণকে স্বাবলম্বী ও আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণে সচেতন করে তুলতে সামাজিক কার্যক্রমের ভূমিকা অপরিসীম। এছাড়া বর্তমান সমাজে খাদ্যে ভেজাল, বিষক্রিয়া এবং রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের ফলে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। ব্যবসায়ী ও ভোক্তা শ্রেণির মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারে নিবৃত্ত করা এবং এ সমস্ত খাবার পরিহারে জনগণকে সচেতন করতে সামাজিক কার্যক্রম যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে।
৭. দুর্নীতি দূরীকরণ : বাংলাদেশের সমাজকাঠামোয় দূর্নীতি একটি মারাত্মক ব্যধি। দুর্নীতি দেশের সার্বিক উন্নয়নের পথে মারাত্মক প্রতিবন্ধবকতা সৃষ্টি করছে। দূর্নীতির এ ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় কঠোর আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সামাজিক কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৮. দারিদ্র্য বিমোচন : দারিদ্র্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যার মূলে রয়েছে জনসংখ্যাধিক্যজনিত বেকারত্ব ও নারীর নির্ভরশীলতা। এছাড়া আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে উৎপাদনশীল মনোভাবের খুবই অভাব রয়েছে। দারিদ্র্যের যথাযথ কারণ চিহ্নিত করে তা কার্যকরভাবে মোকাবিলার কৌশল উদ্ভাবনে সামাজিক কার্যক্রম প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৯. মাদকাসক্তি দূরীকরণ ও মাদকের ব্যবহার রোধ : বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দ্রুত ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ সমস্যা হলো মাদকাসক্তি। মাদকের সহজলভ্যতা এবং বিভিন্নরকম মনো-সামাজিক কারণে শিশু থেকে শুরু করে কম বেশি সব বয়সী, পেশা ও শ্রেণির মানুষ মাদকে আসক্ত। বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় যুবসমাজ মাদকের ছোবলে আজ কর্মবিমুখ। ফলে সমাজে অনৈতিকতা, খুন, অপরাধসহ নানা সমাজবিরোধী কাজ বেড়ে গেছে। এ অবস্থার বিরুদ্ধে সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তুলে জনগণকে সচেতন করতে এবং প্রচলিত মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করতে সামাজিক কার্যক্রম কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
সামাজিক কার্যক্রম একটি সম্মিলিত কর্মপ্রক্রিয়া। সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন নেতিবাচক অবস্থা যা জনগণের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে এবং সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত করে। এমন অবস্থার অবসান ঘাটিয়ে সমাজের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখাই সামাজিক কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে বর্তমানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, জনসংখ্যাস্ফীতি, ভিক্ষাবৃত্তি, নারী নির্যাতন, যৌতুকপ্রথা, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ, নারীর প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়ন, দুর্নীতি, অপরাধ, কিশোর অপরাধ, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, খাদ্যে ভেজাল, সুচিকিৎসার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামীসহ নানাবিধ সমস্যা বিরাজমান যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ধারাকে বাধাগ্রস্ত করছে। সমাজ থেকে এসকল সমস্যা দূর করে জনসাধারণের স্বাভাবিক সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা পুনরূদ্ধার এবং সামাজিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে সামাজিক কার্যক্রমের ভূমিকা অপরিসীম।