প্রশাসন ও সমাজকল্যাণ প্রশাসন
প্রশাসন (Administration)
প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ দলবদ্ধভাবে জীবনযাপন করে আসছে। আর এই দলবদ্ধ জীবনে কোনো না কোনো নেতা বা গোত্রপ্রধানের নেতৃত্বে কতিপয় নিয়মনীতি অনুসরণ করে চলতে হতো। সময়ের বিবর্তনে রাষ্ট্র ধারণা উদ্ভবের ফলে রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি ও আইনসমূহকে বাস্তব রূপদানের ক্ষেত্রে প্রশাসন ধারণাটি উদ্ভব হয়েছে। সাধারণভাবে প্রশাসন বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝায় যা কোনো ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠানকে তার লক্ষ্যার্জনে কার্য সম্পাদনে নির্দেশনা দান, নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় করে থাকে।
এইচ. বি ট্রেকার বলেন, প্রশাসন হচ্ছে চিন্তা, পরিকল্পনা এবং কার্যক্রমের এমন এক সৃজনশীল প্রক্রিয়া, যা কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কার্যাবলীর সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। এই প্রক্রিয়ায় জনগণের সাথে কাজ করার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ, দায়িত্ব বণ্টন, সাংগঠিক সম্পর্ক স্থাপন, কর্মসূচি পরিচালনা এবং সম্পাদিত কার্যাবলীর মূল্যায়ন করা হয়।
এল. ডি হোয়াইটের মতে, প্রশাসন হচ্ছে এমন একটি কলা, যার মাধ্যমে কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যার্জনের নিমিত্তে মানুষের কার্যাবলীকে নির্দেশনা প্রদান, নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করা হয়।
সূতরাং প্রশাসন হলো এমন একটি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে।
সমাজকল্যাণ প্রশাসন (Social Welfare Administration)
সমাজকল্যাণ প্রশাসন পেশাদার সমাজকর্মের একটি সহায়ক পদ্ধতি। সমাজকল্যাণ অনুশীলনের মৌলিক পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়নে নিয়োজিত এজেন্সি বা প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য পরিচালিত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে সমাজকল্যাণ প্রশাসন হিসেবে নির্দেশ করা হয়ে থকে যা প্রত্যক্ষভাবে সমাজকল্যাণ বা সমাজসেবামূলক কার্যাবলীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যার যথাযথ সমাধান, জনকল্যাণমূলক সেবার প্রবর্তন এবং সামাজিক নীতিকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা, নীতি ও মূল্যবোধের আলোকে পরিচালিত প্রশাসন ব্যবস্থা হলো সমাজকল্যাণ প্রশাসন।
ডি. পাল চৌধুরী সমাজকল্যাণ প্রশাসনের সংজ্ঞায় বলেন, সমাজকল্যাণ প্রশাসন বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যেখানে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কার্যাবলী বাস্তবায়নের পেশাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। সামাজিক নীতি সমাজসেবায় রূপান্তরের প্রক্রিয়া হিসেবেও একে আখ্যায়িত করা যায়।
রাসেল এইচ. কার্জ এর মতে, সমাজকল্যাণ প্রশাসন সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপান্তরের এমন এক বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সেবা, যার দ্বারা নীতি বা পদ্ধতি সংশোধিত হয়।
সুতরাং বলা যায় যে, জনগণের সার্বিক কল্যাণের নিমিত্তে সামাজিক নীতির আলোকে গৃহীত কার্যাবলী ও দায়িত্বের সুসংহত বণ্টন এবং কার্যসম্পাদন প্রক্রিয়াই হলো সমাজকর্ম প্রশাসন। আর এ কার্যসম্পাদনের সকল স্তরে যেমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মসূচি গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নে সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা, কৌশল, নীতি ও মূল্যবোধ অনুশীলিত হয়।
প্রশাসন একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও নীতিমালা নির্ধারণ এবং লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়ন করা হয়। অন্যদিকে সমাজকল্যাণ প্রশাসন হলো সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপান্তর করে তার মূল্যায়ন ও সংশোধন করার সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। সমাজকর্মের সহায়ক পদ্ধতি হিসেবে সমাজকল্যাণ প্রশাসন সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতিসমূহের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের কার্যকর সহায়তা করে থাকে।
সমাজকল্যাণ প্রশাসনের উপাদান (Components of Social Welfare Administration)
সমাজকল্যাণ প্রশাসনের মূখ্য উদ্দেশ্য হলো সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপান্তর করা। আর এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যম হলো সমাজকল্যাণ প্রশাসনের উপাদান। এসব উপাদান একে অপরের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত হয়ে সমাজকল্যাণ প্রশাসনকে কার্যকর ও গতিশীল করে তোলে। নিচে সমাজকল্যাণ প্রশাসনের উপাদানসমূহ আলোচনা করা হলো :
১) কর্মসূচি : সমাজকল্যাণ প্রশাসনের অন্যতম উপাদান হলো প্রোগ্রাম বা কর্মসূচি। সমাজকল্যাণ প্রশাসনের সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় পরিণত করার লক্ষ্যে নানারকম কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। মূলত এজেন্সির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রণীত কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের উপর প্রশাসনের সফলতা নির্ভর করে।
২) অর্থ ও বাজেট : যেকোন প্রশাসনের জন্য অর্থ অপরিহার্য উপাদান। অর্থ ব্যতীত প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি অর্থের যথাযথ ব্যবহার ছাড়া প্রশাসন চালানোও অসম্ভব। বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে অর্থের যোগান, আয়-ব্যয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। বিধায় অর্থ ও বাজেট সমাজকল্যাণ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
৩) কর্মী : প্রশাসনের অপরিহার্য উপাদান হলো কর্মী। দক্ষ ও সক্রিয় কর্মীবাহিনী ছাড়া প্রশাসন ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ে। প্রশাসনে পেশাদার ও অপেশাদারকর্মী নিয়োজিত থাকেন। প্রশাসনের উদ্দেশ্য অর্জন, কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ প্রশাসন প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দক্ষ কর্মীবাহিনী একান্ত আবশ্যক।
৪) কার্যকর সাংগঠনিক কাঠামো : সুষ্ঠু ও কার্যকর সাংগঠনিক কাঠামোর আওতায় উপযুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এই সাংগঠনিক কাঠামোর আওতায় প্রশাসনের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সকল পর্যায়ে যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন সম্ভব।
৫) জনসংযোগ : সমাজকর্মের সেবা কর্মসূচি জনগণের কল্যাণে নিবেদিত। এ কর্মসূচি সংক্রান্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট যথাযথভাবে পৌঁছানোর জন্য জনসংযোগ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেবা কর্মসূচির যথাযথ ব্যবহার ও কর্মসূচি সম্পর্কে জনগণকে অবহিতকরণ, জনসমর্থন যাচাই, আগ্রহ সৃষ্টি ও সমধর্মী প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে জনসংযোগ সমাজকল্যাণ প্রশাসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে।
৬) ভৌত অবকাঠামো : ভৌত অবকাঠামো সমাজকল্যাণ প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভৌত অবকাঠামো ব্যতীত প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে বিভিন্ন কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ ও সম্পন্ন করতে পারেনা। ভৌত অবকাঠামোর মধ্যে অফিস কক্ষ/ভবন, আসবাবপত্র, প্রয়োজনীয় উপকরণাদি, যোগাযোগের জন্য ফোন বা মোবাইল, কম্পিউটার, ইণ্টারনেট সংযোগ, ফটোকপি মেশিন, টেলিভিশন প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৭) পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া : প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য সমাজকল্যাণ প্রশাসনের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া রয়েছে। এসকল পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রশাসনের কার্যাবলী যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হয়।
৮) গবেষণা ও মূল্যায়ন : সমাজকল্যাণ প্রশাসন প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো গবেষণা ও মূল্যায়ন। বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে সমস্যা নির্ণয়, সমস্যা সমাধানে নতুন নতুন কৌশল ও পদ্ধতি উদ্ভাবন, এজেন্সির কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যথাযথ তথ্য জানার জন্য গবেষণা ও মূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের সেবার মান ও কর্মীবাহিনীর দক্ষতা যাচাই এবং এজেন্সির কর্মসূচির সফলতা ও ব্যর্থতা নিরূপনের জন্য গবেষণা ও মূল্যায়ন অত্যাবশ্যক।
সমাজকল্যাণ একটি সক্ষমকারী পেশা। সমাজকর্মের সহায়ক পদ্ধতি হিসেবে সমাজকল্যাণ প্রশাসন সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপান্তর করে থাকে। এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ প্রশাসনকে সার্বিকভাবে সহায়তায় এর উপাদানসমূহ
সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। সমাজকল্যাণ প্রশাসনের উপাদানগুলো হলো: ১) কর্মসূচি, ২) অর্থসংস্থান ও বাজেট, ৩) কর্মীবাহিনী, ৪) কার্যকর সাংগঠনিক কাঠামো, ৫) গণসংযোগ, ৬) পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া, ৭) ভৌত কাঠামো এবং ৮) গবেষণা ও মূল্যায়ন। সমাজকল্যাণ প্রশাসনের উপাদানসমূহ একে অপরের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত হয়ে সমাজকর্ম প্রশাসনকে কার্যকর ও গতিশীল করে তুলতে যথাযথ ভূমিকা পালন করে থাকে।
সমাজকল্যাণ প্রশাসনের গুরুত্ব (Importance of Social Welfare Administration)
সমাজকর্ম একটি সক্ষমকারী পেশা যা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানবিক সম্পর্ক এবং ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিকে সামাজিক ও সমষ্টিগত সন্তুষ্টি এবং স্বাধীনতা লাভে একক বা দলগতভাবে সহায়তা করে থাকে।
এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ প্রশাসন বহুমুখী কার্যসম্পাদন করে থাকে। সমাজকল্যাণ প্রশাসন সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করে প্রতিষ্ঠানের সেবার মানোন্নয়নে সচেষ্ট হয়। এটি একটি সহযোগিতামূলক সেবাকর্ম যা বিভিন্ন কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানবকল্যাণে ব্রতী হয়। সমাজকল্যাণ প্রশাসনের কার্যক্রম সম্পকে এম. এন. হুসাইন ও এম. আলাউদ্দিন বলেন, এটি এমন একটি কার্যক্রম যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি বিভিন্নভাবে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। এটি সহযোগিতামূলক ও পরিব্যাপক কাজ যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করে এবং প্রত্যেকেই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়।
প্রতিষ্ঠানের গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনকল্যাণে মাজকল্যাণ প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে কতগুলো শিরোনামে এর গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. অনুকুল পরিবেশ তৈরি : সমাজকল্যাণ প্রশাসনের সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো প্রশাসনের অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টি করা। প্রশাসনের অভ্যন্তরে জটিলতা সৃষ্টি হলে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন ব্যাহত হয়। এজন্য প্রশাসন যোগাযোগ, সমন্বয়, তত্ত্বাবধায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে অনুকূল কর্মপরিবেশ তৈরি করে।
২. এজেন্সির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ : সমাজকল্যাণ প্রশাসন এজেন্সির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানে প্রচলিত সেবাকার্যক্রম বিশ্লেষণ করে এজেন্সির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
৩. জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ : সমাজকল্যাণ প্রশাসন লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে পরস্পরের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ভিত্তিতে সক্রিয় অংশগ্রহণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। কেননা লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীর সকলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সমষ্টির নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সচেষ্ট হয়।
৪. সমন্বয় সাধন : সমাজকল্যাণ প্রশাসন সর্বদা সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপান্তরে সচেষ্ট থাকে। সামাজিক নীতি বাস্তবায়নের প্রধান উপায় হলো পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ প্রশাসন এজেন্সির বিভিন্ন কার্যক্রম ও উপবিভাগ এবং সমষ্টিতে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে থাকে।
৫. দ্বন্দ্ব নিরসন ও সামঞ্জস্যবিধান : সমাজকল্যাণ প্রশাসন এজেন্সিতে কর্মরত কর্মীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। এজেন্সিতে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় যা এজেন্সির লক্ষ্য অর্জনের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। এছাড়া অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতির সঙ্গে অনেকেই খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ প্রশাসন এজেন্সির নিয়মনীতি ও কার্যাবলীর সাথে কর্মীদের সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করে থাকে।
৬. নিয়ন্ত্রণ ও উদ্বুদ্ধকরণ : প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সর্বস্তরের কর্মীদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সমাজকল্যাণ প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের অভাবে কর্মীদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দেয়, ফলে সেবার মান ক্ষুন্ন হয় এবং প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জন ব্যর্থ হয়। এ কারণে প্রয়োজনে কর্মীদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়ে।
আবার অনেক সময় সমাজকল্যাণ প্রশাসন সহকর্মীদের মধ্যে বাস্তবজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এজেন্সির কার্যাবলীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনুপ্রাণিত করতে প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, অবসরভাতা, বিনোদনভাতা, বেতন বৃদ্ধিসহ নানাধরনের প্রেষণামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে। ফলে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
৭. পরামর্শ ও তত্ত্বাবধান : সমাজকল্যাণ প্রশাসন জনগণের কল্যাণধর্মী সেবায় নিয়োজিত একটি কর্মপ্রক্রিয়া। সমাজকল্যাণ প্রশাসন তাই প্রয়োজনে জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে। আবার অনেক সময় সমধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে থাকে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কার্যক্রমের যথাযথ তত্ত্বাবধানে সমাজকর্ম প্রশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণীত হচ্ছে কিনা, গৃহীত কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, কর্মীবাহিনী তাদের দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কি না তা নিরূপন করা হয়।
৮. বাজেট প্রণয়ন : প্রতিষ্ঠানের বাজেট প্রণয়নে সমাজকল্যাণ প্রশাসনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিষ্ঠানের সেবাদানের যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তাই হলো বাজেট। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগ প্রথমে আলাদা আলদা খসড়া বাজেট তৈরি করে। খসড়া বাজেটের আলোকে বাজেট কমিটি চূড়ান্ত বাজেট প্রণয়ন করে। মূলত বাজেটের আলোকেই প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ের (সাধারণত এক বছর) জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে।
৯. নথিপত্র সংরক্ষণ : প্রতিষ্ঠানের গঠণতন্ত্র, আয়-ব্যয়ের হিসাব, বার্ষিক রিপোর্ট, কর্মীদের পরিচিতি, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিবরণীসহ বিভিন্ন নথিপত্র সংরক্ষণে সমাজকল্যাণ প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ধরনের নথি সংরক্ষণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে ।
১০. গবেষণা ও মূল্যায়ন : প্রতিষ্ঠানের গৃহীত কর্মসূচি লক্ষ্যদলের চাহিদার পূরণ ও সমাধান কতটা কার্যকর, কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে কি না; যদি সম্ভব না হয় তাহলে এর কারণ কী এসব বিষয় যাচাইয়ের জন্য সমাজকল্যাণ প্রশাসন গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কোনো কর্মসূচি পুনরায় গ্রহণ হবে কি না ? কর্মসূচির পরিমার্জন ও পরিবর্ধন হবে কি না তা মূল্যায়ন করা হয় ।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে সমাজকল্যাণ প্রশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম।
সমাজকল্যাণ প্রশাসন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানবকল্যাণ সাধনে সচেষ্ট। সমাজকল্যাণ প্রশাসন বহুমুখী কার্য সম্পাদন করে থাকে। সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন করে প্রতিষ্ঠানের সেবার মান উন্নয়নে সামাজিক প্রশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজকল্যাণ প্রশাসন: ১) প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টি, ২) এজেন্সির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, ৩) জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, ৪) সমন্বয় সাধন, ৫) দ্বন্দ্ব নিরসন ও সামাঞ্জস্যবিধান, ৬) কর্মী নিয়ন্ত্রণ ও অনুপ্রাণিতকরণ, ৭) পরামর্শ ও তত্ত্বাবধান, ৮) বাজেট প্রণয়ন, ৯) নথিপত্র সংরক্ষণ এবং ১০) গবেষণা ও মূল্যায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।